একনায়কত্ব কথাটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ডিক্টেটরশিপ (ইংরেজি: Dictatorship) লাতিন দিক্তাতুরা (dictatura) থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ হলো কোনও ব্যক্তির অথবা গােষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ও একচ্ছত্র শাসনব্যবস্থা, যাতে শাসিতদের কোনও সম্মতির প্রয়ােজন হয় না। প্রত্যয়টি রােমান রিপাবলিক আমল থেকে প্রচলিত যখন আপতকালে সেনেটে কোনও ব্যক্তিকে ছয় মাসের জন্য একনায়ক হিসেবে নিয়ােগ করা হতো। সে সময়ে তিনি নিরঙ্কুশ শাসনের একচ্ছত্র অধিকারী হতেন। সমস্ত আইনকানুন রদ করার ক্ষমতা থাকত তাঁর। সময় অতিক্রান্ত হলে নিয়মতন্ত্র পূঃপ্রতিষ্ঠিত হতো, একনায়ক অবসর নিতেন। কালক্রমে ইংরেজি ডিক্টেটর শব্দের অর্থে ব্যতিক্রম ও বিকৃতি ঘটে।[১]
মুক্তির উদগাতা ফরাসি দার্শনিক রুশো প্রাচীন রােমান রীতি অনুযায়ী আপৎকালে রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য ডিক্টেটরি প্রথার অনুবর্তন সমর্থন করেন। রােমানরা মনে করত যে ডিক্টেটরের কার্যকাল বেশি হলে ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটবে। তা ছাড়া যে আপতকালের জন্য ডিক্টেটর নিয়ােগের সাময়িক প্রয়ােজন হয় তার পক্ষে ছয় মাসই যথেষ্ট।
একালের ডিক্টেটররা কিন্তু একবার একচ্ছত্র ক্ষমতার স্বাদ পেলে আর ছাড়তে চান না। স্পেন ও পর্তুগালসহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই একনায়কেরা স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিলেন ও এখনও আছেন কিছু কিছু। বর্তমানকালের একনায়কদের স্বৈরতন্ত্রী বলাই ভাল। এযুগের একনায়কেরা সংশ্লিষ্ট দেশের পূর্বতন রাজার ন্যায় আচরণ করেন।
একনায়কদেরও ভাল ও মন্দ উভয় দিকই থাকে | একনায়কদের মধ্যে অনেকেই আপামর জনগণের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়। সব রাজা, একনায়ক বা একচ্ছত্রাধিপতি, অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী নন। প্লাতাে, বেকন ও মধ্যযুগের কোনও কোনও পণ্ডিত ব্যক্তি সদয় একচ্ছত্রাধিপতির (benevolent despot) গুণগান করেছেন।
ফরাসি বিপ্লবের পর গণতন্ত্রের প্রবর্তন হবার ফলে একচ্ছত্রাধিপতিদের কাল শেষ হলেও নতুন আকারে একনায়কত্ব বা ডিক্টেটরশিপ দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি, গােষ্ঠী, পার্টি, শ্রেণী ইত্যাদি ধরনের একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে দুনিয়ার বিবিধ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মূলত তিন প্রকারে বিভক্ত করা যায়। সেই তিন প্রকার রাষ্ট্র ব্যবস্থা হচ্ছে (১) বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্বাধীন প্রজাতন্ত্র, (২) সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বাধীন প্রজাতন্ত্র, এবং (৩) কয়েকটি বিপ্লবী শ্রেণির যুক্ত একনায়কত্বাধীন প্রজাতন্ত্র।[২]
ছবির ইতিহাস: বিশ শতকের তিন মহা একনায়ক, এডলফ হিটলার, উইনস্টন চার্চিল এবং বেনিতো মুসোলিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই তিন একনায়ক হত্যা করেছে তিন কোটি মানুষ।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬।
২. মাও সেতুং, নয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে, জানুয়ারি ১৯৪০, অধ্যায় ৫ নয়া গণতন্ত্রের রাজনীতি, অনুচ্ছেদ ১০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।