সারবস্তু ও রূপ প্রসঙ্গে

সারবস্তু ও রূপ বা মূল ও প্রকাশ (ইংরেজি: Essence and Appearance) হচ্ছে একটি দার্শনিক প্রশ্নের প্রকাশ। অস্তিত্ব বা সত্তার মূল চরিত্র এবং তার সৃষ্টি বা প্রকাশের মধ্যকার সম্পর্ক এবং উভয়ের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ দর্শনের একটি আবহমান প্রয়াস। মানুষের প্রত্যক্ষভাবে যে অভিজ্ঞতার সম্পর্কে জড়িত হয়, তাকে সে অপর কোনো কিছুর প্রকাশ মনে করে। গভীরতর কোনো অস্তিত্ব এবং সাধারণভাবে দৃশ্যমানতার প্রকাশের পার্থক্য-বোধ মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান বস্তু জগতের সতত পরিবর্তন থেকেই প্রথমে উদ্ভূত হয়।

দৃশ্যমান জগতের অনেক কিছুই ক্ষণকালের। এই আছে, এই নাই। কিন্তু ক্ষণকালও আপেক্ষিক কথা।পরিবর্তমান জগতের কারুর স্থিরতা মুহুর্তকালের, কারুর স্থিরতা বা স্থায়িত্ব যুগব্যাপী। যে যত বেশী স্থায়ী তাকে তত বেশী মৌলিক এবং যে যত ক্ষণকালের তাকে স্থায়ী অস্তিত্বের প্রকাশমাত্র বলে মানুষ বিবেচনা করেছে। অধিকতর স্থায়ী বা স্থিরকে অধিক মূল্যদান মানুষের জীবনের প্রয়োজনের দিক থেকে স্বাভাবিক। ক্ষণকাল থেকে অধিককাল স্থায়ী অস্তিত্বের কল্পনার সঙ্গে মানুষ বস্তুর পরিবর্তনের হ্রাসবৃদ্ধিকেও যুক্ত করেছে। মানুষ মনে করেছে, যে বস্তু যত অধিককাল একরূপে স্থায়ী, তার পরিবর্তন ক্ষণকালের বস্তুর চেয়ে কম। এই পরিমাণ-বোধ থেকে মানুষ কল্পনা করার প্রয়াস পেয়েছে: এর চরম মূলে আছে যে অস্তিত্ব, সে-ই চিরস্থায়ী এবং সে অস্তিত্বের আদৌ কোনো পরিবর্তন নেই।

শুধু অপরিবর্তনীয় নয়। নিত্যকালের স্থায়ী অস্তিত্ব আদৌ বস্তু নয়। বস্তু সতত পরিবর্তিত হয়। প্রাচীন কালের প্লেটো কিংবা আধুনিক কালের কাণ্ট, হেগেল এঁরা চিরস্থায়ী কিংবা অপরিবর্তনীয় স্থির অস্তিত্বকে পরমভাব কিংবা অজ্ঞেয় সত্তা বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকে আবার চিরস্থায়ীকে একমাত্র সত্য এবং প্রকাশকে অসত্য বা মায়া বলে বিবেচনা করেছেন। কেউ কেউ মূল এবং প্রকাশের পার্থক্য অস্বীকার করে মুহুর্তের দৃশ্য প্রকাশকেই একমাত্র সত্য অস্তিত্ব বলে ঘোষণা করে মূলের অস্তিত্ব নাকচের প্রবণতা দেখিয়েছেন।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অস্তিত্বের সারবস্তু এবং রূপকে বৈজ্ঞানিক এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এই মত অনুযায়ী সারবস্তু এবং রূপ পরস্পর নির্ভরশীল অস্তিত্ব। বীজ থেকে অঙ্কুর হয়। অঙ্কুর থেকে বৃক্ষ। এখানে বৃক্ষের মূল অঙ্কুর এবং অঙ্কুরের মূল বীজ – একথা বলা অসঙ্গত নয়।

আরো পড়ুন:  বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ কাকে বলে?

বস্তুত প্রত্যেক অস্তিত্বেরই দুটি দিক আছে: একটিকে অন্যটির তুলনায় সারবস্তু অথবা রূপ বলা চলে। সারবস্তু এবং রূপের পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। সারবস্তু ব্যতীত রূপ নেই। রূপ বলতেই কোনো কিছুর রূপ। আবার কোনো সারবস্তুই রূপহীন হতে পারেনা। চরম স্থির সারবস্তু বলেও কোনো অস্তিত্ব নেই। বস্তু হচ্ছে চরম অস্তিত্ব। কিন্তু কোনো রূপই বা কোনো রূপই অপরিবর্তনীয় নয়। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আবিস্কারকে স্বীকার করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলে যে, বস্তুর সারবস্তু যে উপাদান, ইলেকট্রন-নিউট্রন-প্রোটন, সে উপাদানও জটিল, নিয়ত গতিময় ও পরিবর্তনশীল।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৫৭-১৫৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!