প্রয়োজনীয়তা ও স্বাধীনতা বা অনিবার্যতা ও স্বাধীনতা (ইংরেজি: Necessity and Freedom) হচ্ছে মানুষের ক্রিয়াকর্ম এবং সমাজ ও প্রকৃতির বিধানের মধ্যকার সম্পর্কের সমস্যাসূচক দার্শনিক ধারণা। মানুষ তার কর্মের ক্ষেত্রে কি স্বাধীন, না প্রকৃতি ও সমাজের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? মানুষ স্বাধীন না নিয়মের দাস? স্বাধীনতার অর্থ কি? নিয়ম-নিরপেক্ষ কোনো স্বাধীনতার অস্তিত্ব কি সম্ভব? এই প্রশ্নগুলি দর্শনে বিশেষ আলোচিত প্রশ্ন।
ভাববাদী দর্শনে স্বাধীনতা ও প্রয়োজনীয়তা বা অনিবার্যতাকে পরস্পর-বিরোধী ধারণা বলে মনে করা হয়। এই দর্শনের মতে স্বাধীনতা হচ্ছে আত্মা বা ইচ্ছার স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার সঙ্গে আত্মার বহির্গত কোনো অবস্থা বা বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। মানুষের আত্মা বা ইচ্ছা হচ্ছে চরম আত্মা বা চরম ইচ্ছার প্রকাশ। চরম আত্মা চরমভাবে স্বাধীন। ব্যক্তির মধ্যে তার প্রকাশও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। কারণ মানুষের ইচ্ছা যদি পরিবেশের অধীন হয়, তা হলে মানুষের উপর কোনো কাজের নৈতিক দায়িত্ব আরোপ করা চলে না।
মানুষ ইচ্ছার ক্ষেত্রে স্বাধীন বলেই তার কাজের নীতিগত বিচার সম্ভব। কাজেই মানুষের স্বাধীনতার কোনো নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না। এই নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতার একেবারে বিপরীত প্রান্তের মত হচ্ছে যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণবাদ। যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণবাদের মতে, মানুষের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকতে পারে না। মানষ হচ্ছে প্রাকৃতিক বিধানের দাস। তার প্রতিটি আচরণ ও তার কাজ অনিবার্যভাবে এই বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ দর্শনে তাই মানুষ প্রাকৃতিক বিধানের অসহায় ক্রীড়নক বৈ আর কিছু নয়। কিন্তু ভাববাদী স্বাধীনতা আর যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণবাদ উভয়ই স্বাধীনতা ও প্রয়োজনীয়তা বা অনিবার্যতার অবৈজ্ঞানিক একতরফা ব্যাখ্যা।
প্রয়োজনীয়তা ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কিত সত্য। উভয়ের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক উপলব্ধির মধ্যেই এদের যথার্থ চরিত্র বোঝা সম্ভব। এই সম্পর্ক উপলব্ধির প্রথম প্রয়াস দেখা যায় স্পিনোজার দর্শনে। তিনি কোনো বিধান বা অবস্থার অপরিহার্যতার উপলব্ধিকে ব্যক্তির স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ মাধ্যাকর্ষণের অধীন। মানুষ এমন কোনো স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না, যে স্বাধীনতায় সে মাধ্যাকর্ষণকে অস্তিত্বহীন বলতে পারে। কিন্তু মানুষ যখন উপলব্ধি করে, কেন সে মাধ্যাকর্ষণের অধীন তখনি মাত্র সে মাধ্যাকর্ষণের অধীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম বা নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সে অর্জন করতে পারে।
কাজেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাস্তব বিধানের অপরিহার্যতার কারণ সচেতনভাবে উপলব্ধির মধ্যেই মানুষের স্বাধীনতা নিহিত। মানুষ প্রকৃতির পরিপূর্ণ দাস ছিল সেই আদিম যুগে, যখন সে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করতে অক্ষম ছিল। তখন সে প্রকৃতির বিধানকে জানত না। আজ মানুষ ক্রমাধিক পরিমাণে প্রকৃতির প্রভু হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রকৃতির বিধানকে লঙ্ঘন করে নয়, প্রকৃতির বিধান সম্যকভাবে জ্ঞান হওয়ার মাধ্যমেই। বিধানহীন চরম স্বাধীনতা বলে মানুষের কিছু থাকতে পারে না। আবার বস্তুজগতের সে অসহায় ক্রীড়নকও নয়। মানুষ বস্তু, জগৎ ও সমাজের বিধান যত জ্ঞাত হতে পারে, বস্তু, জগৎ ও সমাজকে পরিবর্তন করার স্বাধীনতাও সে তত অর্জন করতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭৬-১৭৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।