কমিউনিস্ট নৈতিকতা হচ্ছে সাম্যবাদী আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক কৃষক জনগণের সামাজিক মালিকানা সংশ্লিষ্ট নৈতিকতার ধারাবাহিক অনুশীলন। মার্কসবাদী দর্শন অনুযায়ী ধর্ম, রাজনীতি, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয় সামাজিক শ্রেণি সম্পর্ক ও উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তির উপর গঠিত উপরিকাঠামাের অন্তর্গত। কিন্তু নতুন সমাজ অভিমুখে সমাজতন্ত্রী আন্দোলনে কতকগুলি নৈতিক মান ও আদর্শ অনুসরণ করার কথা বলা হয়, যেগুলি কমিউনিস্টদের জয়যাত্রার পক্ষে অপরিহার্য।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সােভিয়েত ইউনিয়নের দ্বাবিংশ কংগ্রেসে কিছু নৈতিক আচরণবিধি গৃহীত হয়। সংক্ষেপে সেগুলি হলো: ১. প্রগতিবাদী সামাজিক শক্তি বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি যে সব রীতিনীতি নির্ধারণ করে; ২. নৈতিক উন্নতির জন্য সমাজতন্ত্রী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত সুফল সমূহ আচরণবিধিতে প্রতিফলিত হয়; ৩. অধিকতর নৈতিক সুফল অর্জনের পথে অগ্রসর হবার জন্য চাই কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি সানুরাগ আত্মনিয়ােগ; সমাজতান্ত্রিক মাতৃভূমি এবং অন্যান্য সমাজতন্ত্রী দেশের প্রতি ভালবাসা।[১] লেনিন উল্লেখ করেছেন যে,
“শ্রেণিসংগ্রাম চলছে এবং আমাদের কর্তব্য হলো সমস্ত স্বার্থকে তার অধীনস্থ করা। কমিউনিস্ট নৈতিকতাকেও আমরা এই কর্তব্যের অধীন করি। আমরা বলি: সাবেকী শোষক সমাজের ধ্বংস এবং নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা প্রলেতারিয়েতের চারপাশে সমস্ত মেহনতীদের ঐক্যবন্ধনে যা সাহায্য করে, সেইটাই নৈতিকতা।”[২]
এছাড়াও সমাজের উন্নয়নে বিবেকসম্পন্ন দায়িত্ব পালন— যে মানুষ কাজ করে না সে মানুষ খাদ্যের অধিকারী নয়; জনসম্পদ বৃদ্ধি ও রক্ষার জন্য প্রত্যেকের মমত্ববােধ; জনস্বার্থে কর্তব্যবােধ; অসহিষ্ণুতা জনস্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর; যৌথস্বার্থের মানসিকতা এবং সহকর্মীসুলভ (comradely) পারস্পরিক সাহচর্য; একে সকলের তরে, সকলে একের তরে; সৌহার্দপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক এবং সকলের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন— মানুষের কাছে মানুষ বন্ধু, সহকর্মী (কমরেড) এবং ভাই।[৩] লেনিন উল্লেখ করেছেন যে,
“কমিউনিস্টের কাছে যাবতীয় নৈতিকতা রয়েছে এই অটুট সংহত শৃঙ্খলায় ও শোষকদের বিরুদ্ধে সচেতন গণসংগ্রামে। শাশ্বত নৈতিকতায় আমাদের বিশ্বাস নেই এবং নৈতিকতা নিয়ে আষাঢ়ে যত গল্পের বুজরুকি আমরা ফাঁস করি। মানব সমাজকে উচ্চতর স্তরে উন্নয়ন ও শ্রম-শোষণ থেকে তার অব্যাহতির কাজে লাগবে নৈতিকতা।”[৪]
সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সততা, সত্যানুরাগ, নৈতিক পবিত্রতা; শালীনতা ও মুক্তমানসিকতা; পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানপ্রদর্শন এবং সন্তানসন্ততি পালনে নিষ্ঠা; অবিচারের প্রতি আপসহীন মনােভাব; পরান্নজীবিকা ও সুযােগসন্ধানে অনাসক্তি; সারা দেশের সকলের প্রতি বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের মনােভাব; জাতিবিদ্বেষ পরিহার; কমিউনিজমের শত্রুদের প্রতি আপসহীন মনােভাব; সকল জাতির শান্তি ও স্বাধীনতা কামনা; সকল দেশের শ্রমজীবীদের সঙ্গে সুসংবদ্ধ মৈত্রীর বন্ধন।
দ্রষ্টব্য: ভিত্তি ও উপরিকাঠামো
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৯-৭০।
২. ভ ই লেনিন, যুব লীগের কর্তব্য, ২ অক্টোবর ১৯২০, রচনা সংকলন, চার ভাগে সম্পূর্ণ, চতুর্থ ভাগ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৬
৩. পূর্বোক্ত, গঙ্গোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৭০
৪. পূর্বোক্ত লেনিন পৃষ্ঠা ১৭৬
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।