শ্রম (ইংরেজি: Labour) বলতে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার শ্রমকেই বুঝায়। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রয়েছে প্রতিমুহুর্তে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক। বস্তুজগৎ যেমন মানুষকে স্পর্শ করে এবং আঘাত করে, মানুষও তেমনি বস্তুজগতকে স্পর্শ করে ও প্রত্যাঘাত করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি ও মানুষ উভয়েরই পরিবর্তন ঘটে। মানুষের হাতের যেমন ক্ষমতা আছে শক্ত পাথরকে হাতুড়ির আঘাতে চূর্ণ করার, তেমনি পাথরের ক্ষমতা আছে সেই শক্তিমান হাতের নরম তালুকে কড়াপরা কর্কশ তালুতে পরিবর্তিত করে দেওয়ার।
মানুষ তাই শুধু প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে না, সে নিজেও প্রকৃতি দ্বারা পরিবর্তিত হয়। তাই কার্ল মার্কস তাঁর পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বলেছেন, ‘শ্রম হচ্ছে প্রধানত মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রক্রিয়া। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ ক্রমান্বয়ে এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়’।
মানুষের হাতে প্রকৃতির পরিবর্তনের মূলে আছে মানুষের শ্রম। শ্রমের তিনটি দিক। ১. মানুষ কোনো একটা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শ্রম করে। ২. মানুষ বাস্তব কোনো বস্তু বা বিষয়ের উপর তার শ্রম প্রয়োগ করে। ৩. শ্রমের উপায় হিসাবে মানুষ যন্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করে। মানুষের অস্তিত্বের প্রধান শর্ত হচ্ছে শ্রম। শ্রম ব্যতীত মানুষ জীবন রক্ষা করতে পারে না। আবার এই শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ পশুর স্তর থেকে নিজেকে মানুষের স্তরে উন্নত করতে পেরেছে। পশুর সঙ্গে মানুষের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে এই যে পশু যেখানে প্রকৃতির দানের উপর নির্ভর করে নিজের জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করে, মানুষ সেখানে শ্রমের মাধ্যমে সে প্রকৃতিকে নিজের দাসে পরিণত করে প্রকৃতি দ্বারা নিজের উদ্দেশ্য সাধন করার চেষ্টা করে।
কিন্তু মানুষের সামাজিক অর্থনীতি অবস্থার বিভিন্ন স্তরে শ্রম বিভিন্নভাবে বিবেচিত ও ব্যবহৃত হয়েছে। আদি সাম্যবাদী সমাজে শ্রম ছিল মানুষের যৌথশক্তি। মানুষ যৌথ ও সম্মিলিতভাবে শ্রম করত, শ্রমের উপায় বা হাতিয়ারকে যৌথ মালিকানায় ব্যবহার করত এবং শ্রমের মাধ্যমে লব্ধ ফল ফসল সম্পদকে যৌথভাবে ভোগ করত। এরূপ স্তরে এক মানুষের হাতে অন্য মানুষের শ্রমশক্তির শোষণের কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু কালক্রমে সমাজ দ্বন্দ্বমান সমাজে শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়। দ্বন্দ্বমান সমাজে শ্রম আর প্রকৃতির পরিবর্তনে যৌথশক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হয় না। শ্রমই জীবনরক্ষা ও তার দৈহিক ও মানসিক আরাম আয়াসের মূল হওয়াতে একের শ্রম ব্যবহার করে অপরের সুখসম্ভোগ নিশ্চিত করার প্রয়াস চলতে থাকে। দুর্বল শ্রেণীর শ্রম সবলতর শ্রেণী নিজের স্বার্থে শোষণ করতে শুরু করে।
দাস সমাজে দাসের শ্রমে প্রভুর সম্পদ, সামন্তবাদী সমাজে চাষীর শ্রমে ভূস্বামীর সম্পদ এবং ধনতান্ত্রিক সমাজে কলকারখানার শ্রমিকের শ্রমের শোষণে পুঁজিপতির ধনের বৃদ্ধি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রমকে আর মুক্তশ্রম বলা চলে না। শ্রম এখানে শৃঙ্খলিত। কিন্তু কালক্রমে আবার শৃঙ্খলিত শ্রমিক বিপ্লব করে শ্রমের মুক্তি সাধন করে। শ্রেণীহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃতিকে আয়ত্ত করার সঠিক প্রচেষ্টায় শ্রমিক শ্রেনী মুক্ত শ্রমের যৌথ প্রয়োগের সম্ভাবনাকে সম্ভব করে তোলে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।