সাধারণত কোনো জনসমাজ যদি একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী হয়, একই ভাষায় তারা ভাবের আদানপ্রদান করে, একই ঐতিহ্য এবং আশা আকাঙ্খার বাহক হয় এবং রাষ্ট্রীয় সীমানায় আবদ্ধ থাকে কিংবা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয় তাহলে এরূপ জনসমাজকে জাতি (ইংরেজি: Nation) বলে অভিহিত করা হয়। বাংলায় জাতি শব্দের অবশ্য একাধিক অর্থে ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ধর্মের ভিত্তিতেও এক জনসমাজ নিজেকে বা অপর সমাজকে জাতি বলে চিহ্নিত করে থাকে। অনেক সময় হিন্দু কিংবা মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান জনসমাজের লোক নিজেদের হিন্দু জাতি বা মুসলিম জাতি বা খ্রিষ্টান জাতির লোক বলে অভিহিত করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যবহৃত ‘জাতি’ সত্তার অস্তিত্ব ইতিহাসে সর্বদা ছিল না। আধুনিককালে জাতিকে সাধারণত রাষ্ট্রের ভিত্তিতে সংগঠিত জনসমাজ বলে মনে করা যায়। কিন্তু একইরূপ জনসমাজের রাষ্ট্ররূপে সংগঠিত অবস্থা ইতিহাসের আদি স্তরে দেখা যায় না। প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন গোত্রের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে বাস করত। কিন্তু একটি গোত্রের মধ্যে ঐক্যসূত্রের অস্তিত্ব থাকলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিধিবিধান দ্বারা সংগঠিত ছিল না। জনসমাজে জীবিকার ক্ষেত্রে শক্তির তারতম্যের উদ্ভবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দৃষ্টি থেকে জনসমাজে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উদ্ভব ঘটে। এই পর্যায় দাস পর্যায় বলে পরিচিত। কিন্তু দাস পর্যায়ের জনসমাজকেও জাতি বলা হতো না।
সামন্তযুগে ইউরোপের ভূখন্ড বিভিন্ন ভূস্বামী ও সম্রাটের মধ্যে বিভক্ত ছিল। য়ুরোপে জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের সংকীর্ণ এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডকে একত্রীকরণের মাধ্যমে নতুনতর ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ সুগম করার প্রয়োজন বোধ ও প্রয়াস হতে। এই প্রক্রিয়ায় ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং য়ুরোপে জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ প্রভৃতি জাতি এবং জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে।
ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীকালে এই জাতীয়তাবোধ আবার ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের পরস্পর বিরোধিতা এবং আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি করে। একটা ধনিক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রকে নিজের শত্রু বলে বিবেচনা করে। এর মূলে অবশ্য থাকে একের অর্থনীতিক আধিপত্য অপরের উপর প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অসঙ্গতি এবং সঙ্কট অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের সৃষ্টি করে এবং এর পরিণামে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে জনসমাজধ্বংসী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
জাতীয়তাবাদের দুটি রূপ ইতিহাসে সুস্পষ্ট। একটা তার সংগ্রামী ও প্রগতিশীল ভূমিকা। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ একটা জনসমাজকে মুক্তির সংগ্রামে সংগঠিত করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। আবার উগ্র জাতীয়তাবাদ একটা জনসমাজের মধ্যে গর্ব, অহংকার এবং আগ্রাসী মনোভাব সৃষ্টি করে মানুষের অমঙ্গলের কারণ হতে পারে। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান জঙ্গি জাতীয়তাবাদ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং পৃথিবীর মহা অকল্যাণ সাধন করে। মানুষের সমাজ থেকে শ্রেণীবিভক্ত শোষণ বিদূরিত হলে মানুষের জাতিভিত্তিক বিভাগের গুরুত্ব হ্রাস পাবে, বিশেষ করে জাতিতে জাতিতে বৈরীমূলক সম্পর্কের আশঙ্কা দূরীভূত হবে বলে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদগণ কল্পনা করেন।
‘এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ এরূপ অবিমিশ্র রাষ্ট্রের সাক্ষাৎ খুব বিরল। প্রধানত এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্রের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই বাংলাদেশের মধ্যে বাংলাভাষী জনসমাজ আবদ্ধ নয়। ভারতীয় ইউনিয়নের পশ্চিম বাংলাও বাংলাভাষী সমাজ অধ্যুষিত। আবার বাংলাদেশের মধ্যে কিছু সংখ্যক পার্বত্য উপজাতির অস্তিত্ব রয়েছে যাদের ভাষা বাংলা হতে ভিন্ন।
জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা পরিবর্তিত বা বিভক্ত হতে পারে। মহাযুদ্ধের পরে জার্মান জাতি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানী নামে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছিল। কোরিয়াও বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া নামে বিভক্ত হয়ে আছে। ভিয়েতনামও অনুরূপভাবে বিভক্ত ছিল। ভারতীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া বহু ভাষা ও বহু জাতির রাষ্ট্র।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৯০-২৯১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।