কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার মার্কস ও এঙ্গেলস রচিত মুক্তির নির্দেশনা

কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের যৌথভাবে রচিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার বা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (ইংরেজি: The Communist Manifesto বা Manifesto of the Communist Party) প্রথম প্রকাশিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮ সালে। জার্মান ভাষায় রচিত এই বইটির নাম ছিলো মানিফেস্ট ডেয়ার কোমুনিস্টেন পার্টি (Manifest der Kommunistischen Partei)।[১] ইশতেহারের শীর্ষে তাঁরা ‘দুনিয়ার সকল দেশের শ্রমিক এক হও’ এই আহ্বান ঘোষণা করেন।

সাম্যবাদী বিপ্লবের উদ্দীপনার পেছনে এই গ্রন্থের ভূমিকা আজও সমপরিমাণে অটুট আছে। এটি বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের মহত্তম কর্মসূচি-দলিল। ইশতেহারটি পরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলির মধ্যে একটি হিসাবে স্বীকৃত হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের এবং অন্যান্য লেনিনবাদী পার্টিগুলো মার্কস-এঙ্গেলসের কাজ জানতে ইচ্ছুক থাকায় এই বইটি খুব গুরুত্ব লাভ করে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতি উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই বইটি পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের পড়ার প্রয়োজনবোধ করা হয় গত দেড়শত বছর ধরেই।[২]

ইশতেহারের প্রণয়ন ও পরবর্তী বিকাশের ইতিহাস

‘কমিউনিস্ট লীগের’ কর্মসূচি হিসাবে মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখা এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে, ২৩ পাতার একটি পৃথক পুস্তিকাকারে। ১৮৪৮ খ্রীস্টাব্দের মার্চ-জুলাই মাসে জার্মান রাজনৈতিক দেশান্তরীদের গণতান্ত্রিক মুখপত্র Deutsche Londoner Zeitung-এ এটি কিস্তিতে কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। সেই বছরেই জার্মান মূল পাঠটি লন্ডনে ৩০ পাতার একটি পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়, তাতে প্রথম সংস্করণের ছাপার ভুলভ্রান্তি সংশোধন ও যতিচিহ্নাদির প্রয়োগ উন্নত করা হয়। পরবর্তী প্রামাণ্য সংস্করণাসমূহের ভিত্তি হিসাবে এই সংস্করণের পাঠটিই মার্কস ও এঙ্গেলস ব্যবহার করেন। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে একাধিক ইউরোপীয় ভাষা তথা ফরাসী, পোলীয়, ইতালীয়, ডেনিশ, ফ্লেমিশ ও সুইডীয় ভাষাতে ‘ইশতেহারের’ অনুবাদ হয়। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের, সংস্করণগুলিতে রচিয়তাদের নাম ছিল না। এ নাম প্রথম ছাপা হয় ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে, ইশতেহারের প্রথম ইংরেজী অনুবাদ তখন প্রকাশিত হয় চার্টিস্ট পত্রিকা Red Republican-এ, তার ভূমিকায় পত্রিকার সম্পাদক জর্জ জুলিয়ান হানি তাঁদের নামোল্লেখ করেন।[৩]

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে কিছু সংশোধন এবং মার্কস ও এঙ্গেলস লিখিত একটা ভূমিকাসহ নূতন একটি জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণটি এবং ১৮৮৩ ও ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের জার্মান সংস্করণের নাম ছিল ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’। এই মহান দলিলের প্রথম রুশ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে, জেনেভায়; অনুবাদ করেছিলেন বাকুনিন, কয়েকটি অনুচ্ছেদে মূল পাঠের বিকৃতি ঘটে। এই প্রথম রুশ সংস্করণের গলদ দূর হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা থেকে প্রকাশিত প্লেখানভের অনুবাদে। রাশিয়ায় ‘ইশতেহারের’ বক্তব্য ছড়ানোয় প্লেখানভের অনুবাদ বহু কাজ দেয়। রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রচারে বিপুল গুরুত্ব দেন মার্কস ও এঙ্গেলস এবং ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের সংস্করণের জন্য একটি বিশেষ ভূমিকা লেখেন।[৪]

মার্কসের মৃত্যুর পর ‘ইশতেহারের’ অনেকগুলি সংস্করণ এঙ্গেলস দেখে দিয়েছিলেন; তাঁর ভূমিকাসহ ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দের জার্মান সংস্করণ, স্যামুয়েল মুর অনুদিত ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের একটি ইংরেজী সংস্করণ, এঙ্গেলস তাঁর সম্পাদনা করেন এবং একটি ভূমিকা ও কতকগুলি টীকা যোগ করেন; এবং ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের জার্মান সংস্করণ, তাতে এঙ্গেলস নূতন একটি ভূমিকা লেখেন ও এই সর্বশেষ সংস্করণটির জন্য কিছু টিকাও যোগ করেন। মার্কসের কন্যা লোরা লাফার্গকৃত ‘ইশতেহারের’ একটি ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয় Socialiste পত্রিকায়, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে, এঙ্গেলস এটি দেখে দিয়েছিলেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের পোলীয় সংস্করণে ও ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ইতালীয় সংস্করণেও ভূমিকা লেখেন এঙ্গেলস।[৫]

ইশতেহারের মূল্যায়ন

কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার হচ্ছে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মার্কসবাদী তত্ত্ব বিকাশের এক সারসংক্ষেপ। সেই সময়ের ভেতরেই তত্ত্বটির ভিত সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং তাতে বর্ণিত হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, দুনিয়াকে উপলব্ধির এবং দুনিয়াকে বদলানোর একটি মৌলিক নতুন প্রত্যয়। এই নতুন প্রত্যয়টিই কেন্দ্রীভূত হয়েছে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের প্রথম আন্তর্জাতিক পার্টি, কমিউনিস্ট লিগের কর্মসূচির ভিত্তিতে।[৬]

কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত সংগ্রামের ভিত্তি নির্মাণ করবার শিক্ষার একটি প্রধান মূলনীতি হচ্ছে তত্ত্ব ও অনুশীলনের ঐক্য। ইশতেহার তত্ত্বের ভিত্তিকে অনুশীলনে নামানোর দিক নির্দেশ করেছে। মার্কসের মৃত্যুর পরে ১৮৮৮ সনের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকার একস্থানে এঙ্গেলস লিখেছিলেন

“যদিও এই ম্যানিফেস্টো আমাদের যৌথ রচনা, তবুও আমার একথা বলা আবশ্যক যে, এই ইশতেহারের মূল যে বক্তব্য তা মার্কসেরই চিন্তাপ্রসূত। এবং এই মূল বক্তব্য হচ্ছে এই দর্শন যে, ইতিহাসের প্রতিটি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং বিনিময়ের প্রধান যে ব্যবস্থা তার উপরই প্রতিষ্ঠিত হয় সে যুগের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধি বা ভাবগত ইতিহাস। এই মূল ভিত্তি দ্বারাই মাত্র এদের ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ফলত মানব জীবনের আদি গোষ্ঠীসমূহের জমির উপর যৌথ মালিকানার পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে শোষক এবং শোষিতের মধ্যকার শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। এবং এই ইতিহাস এখন বিকাশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আজ এমন পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে যেখানে আজকের যুগের শোষিত এবং নির্যাতিত প্রধান শ্রেণি তথা প্রলেতারিয়েত শ্রেণি তার শোষক এবং শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্য থেকে নিজের মুক্তি সমগ্র সমাজের মধ্যে শ্রেণি বৈষম্য এবং শ্রেণি শোষণের বিলোপ সর্বকালের জন্য সাধন করা ব্যতীত অর্জন করতে পারে না”।

রুশ বিপ্লবের নেতা মার্কস ও এঙ্গেলসের মহান উত্তরসূরি ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন কমিউনিস্ট ইশতেহার সম্পর্কে বলেছেন,

“প্রতিভাদীপ্ত স্পষ্টতা ও উজ্জ্বলতায় এই রচনাটিতে রূপায়িত হয়েছে এক নতুন বিশ্ববীক্ষা— সমাজজীবনের এলাকা পর্যন্ত প্রসারিত সুসংগত বস্তুবাদ; বিকাশের সব থেকে সর্বাঙ্গীণ ও সুগভীর মতবাদ— ‘দ্বন্দ্ববাদ’, শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব এবং নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা প্রলেতারিয়েতের বিশ্ব ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভূমিকার তত্ত্ব।”[৭]

তিনি আরো লেখেন, “ছোট এই পুস্তিকাখানি বহু বৃহৎ গ্রন্থের মূল্য ধরে; সভ্য জগতের সমস্ত সংগঠিত ও সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত আজও তার প্রেরণায় সজীব ও সচল।”[৮] ফলে এই গ্রন্থটির মূল্যায়ন হচ্ছে এই যে, ইশতেহারের ধারণাগুলো জানার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি লাভে ইচ্ছুক প্রগতিশীল জনগণ সংগ্রামের পথে উদ্ভূত সবচেয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পায় এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের জটিল প্রক্রিয়াগুলো অনুশীলনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে প্রয়াসী হয় ও আশাবাদ গ্রহণ করে।

কমিউনিস্ট ইশতেহার-এর সারসংক্ষেপ

কমিউনিস্ট ইশতেহারের প্রথম ভাগের নাম “বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত”। এই ভাগে সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদের জন্মের কাহিনী বলা হয়। এছাড়াও সমস্ত দেশের জাতীয় সীমানা এবং প্রচলিত ব্যবসাবাণিজ্য, জীবন ও চেতনার বিলুপ্তি হয়ে যাবার বিবরণ আছে প্রথম পরিচ্ছেদে। মার্কস পুঁজিবাদের আকাশচুম্বী উৎপাদন ক্ষমতাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেন। তার অনুষঙ্গী পরিণতি হিসেবে বলা হয়েছে কীভাবে নগরাঞ্চলে সর্বহারার উত্থান ঘটে, যেটা একটি শ্রেণিতে সুসংবদ্ধ হয়ে একটি দলে সংগঠিত হচ্ছে। ইশতেহারে সর্বহারা শ্রেণির দুঃসহ জীবন কথাসূত্রে সর্বত্র ওই শ্রেণির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ সম্পর্কিত একাত্মতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে শ্রেণিসংগ্রাম থেকে উদ্ভূত সম্পর্কের উপর কমিউনিস্টদের তত্ত্বগত অবস্থিতি নির্ভর করে।[৯]

মার্কস কমিউনিস্ট ইশতেহার রচনায় পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ উদ্ঘাটিত করেছেন। তাঁর মতে অকল্পনীয় হারে পণ্যোৎপাদন বাড়লেও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হয়নি। তিনি পুঁজিবাদের অন্তর্বিরোধ এবং আর্থিক সংকটের বিশ্লেষণ করেছেন। ইশতেহারে পুঁজিবাদের অন্ধকার দিক দেখিয়ে পরিবর্তে অন্য কোনো সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার গতিশীলতা থেকেই ঘটনাক্রমে ধ্বংসাত্মক শক্তির জন্ম হবে।

কমিউনিস্ট ইস্তেহারের দ্বিতীয় ভাগের নাম “প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্টগণ”। এই ভাগে মার্কস ও এঙ্গেলস সমগ্রভাবে প্রলেতারীয়দের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ বিশ্লেষণ করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে, ‘সমগ্রভাবে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র কোনো স্বার্থ তাদের নেই।’ তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, ‘কমিউনিস্টরা হলো একদিকে কার্যক্ষেত্রে প্রতি দেশের শ্রমিক শ্রেণির পার্টিগুলির সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও দৃঢ়চিত্ত অংশ—যে অংশ অন্যান্য সবাইকে সামনে ঠেলে নিয়ে যায়। অপরদিকে, তত্ত্বের দিক দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির অধিকাংশের তুলনায় তাদের এই সুবিধা যে শ্রমিক আন্দোলনের এগিয়ে যাওয়ার পথ, শর্ত এবং শেষ সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ বোধ রয়েছে।’

ইশতেহারের বাকি পরিচ্ছেদগুলিতে সর্বহারা শ্রেণির অনুকুলে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমের নানাবিধ পর্যালোচনা আছে। তার মধ্যে আলোচনায় যে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে সেটা হলো সমস্ত বুর্জোয়া সম্পত্তির বিলোপ সাধন; তার ভিত্তিতে কমিউনিস্টদের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান দানা বেঁধেছে। তত্ত্বটির যৌক্তিকতা এই যে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা থাকার ফলেই সর্বহারা শ্রেণি বিত্তহীন হয়ে পড়েছে এবং সর্বনিম্ন মজুরি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই ব্যক্তিগত মালিকানার অবসানে তাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই এবং সর্বজনের তথা সামাজিক মালিকানাতেই তাদের মঙ্গল। তা ছাড়া সর্বজনের মালিকানার ঐতিহাসিক প্রয়োজনও আছে; কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তির নিরন্তর বিকাশ যেন একটি অপ্রতিরোধ্য দৈত্যের সৃষ্টি করেছে, যেটা কালক্রমে পুঁজিবাদের সংকট ও ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছে।[১০]

ইশতেহারের তৃতীয় অংশে আলোচনা করা হয়েছে ‘সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্য’। মার্কস ও এঙ্গেলস এই অংশকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন যথা প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র, রক্ষণশীল অথবা বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র এবং সমালোচনী — কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম। তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রকে আবার তিন ভাগে ভাগ করেছেন যথা সামন্ত সমাজতন্ত্র, পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র এবং জার্মান অথবা ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্র। সবশেষে চতুর্থ অংশে আলোচনা করেছেন বর্তমান নানা সরকার-বিরোধী পাটির সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ।

কমিউনিস্ট ইশতেহার যেসব বিষয়ের অবসান চেয়েছে সেগুলি হলো বুর্জোয়া আইন ও শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিবার, মোটা আয়কর, রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজি ও পরিবহণ ব্যবস্থা। ইশতেহারে সমসাময়িক বিভিন্ন কল্পলৌকিক ও আবেগপ্রবণ তত্ত্বের সমাজতন্ত্রী বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করা হয়েছে, কারণ সেগুলি ত্রুটিবহুল ও অবৈজ্ঞানিক। সর্বপ্রকার প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে বলপ্রয়োগ করে উচ্ছেদ ঘটানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিশেষে সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির কাছে ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে।

ইশতেহার প্রভাবিত করেছে সমগ্র মানবজাতিকে

কমিউনিস্ট ইশতেহারের ভাষা যেমন সুনির্দিষ্ট তেমনি তার মধ্যে সর্বহারা শ্রেণির ভবিষ্যৎ অনিবার্য বিজয়ের আবেগময় গৌরবান্বিত দৃঢ়তার প্রকাশও সুস্পষ্ট।[১১] মানুষের সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়সমূহের উল্লেখ এবং বিশ্লেষণ এবং সাম্যবাদী কর্মীদের করণীয়ের নির্দেশের পরিশেষে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর অন্তিম অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপে রচনা করা হয়েছে;

‘কমিউনিস্টরা নিজেদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যকে গোপন করতে ঘৃণা বোধ করে। একথা তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করছে যে, তাদের লক্ষ্য কেবল বিদ্যমান সকল সামাজিক অবস্থার জোরপূর্বক উৎসাদনের মাধ্যমেই সম্ভব। শাসক শ্রেণিগুলি কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে কম্পিত হোক। তাদের নিজেদের শৃঙ্খলকে হারানো ব্যতীত সর্বহারার হারাবার কিছু নেই। তাদের জয় করবার জন্য আছে সমগ্র পৃথিবী। দুনিয়ার মজদুর এক হও।”

কমিউনিস্ট ইশতেহারের ভেতর যে মূলচিন্তা প্রবাহমান তা এই যে ইতিহাসের প্রতি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং যে সমাজ-সংগঠন তা থেকে আবশ্যিকভাবে গড়ে উঠে, তাই থাকে সেই যুগের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত ইতিহাসের মূলে। সুতরাং জমির আদিম যৌথ মালিকানার অবসানের পর থেকে সমগ্র ইতিহাস হয়ে এসেছে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্যভাবে আসন্ন অবসানের কথা ঘোষণা করাই ছিল এই বইয়ের প্রধান লক্ষ্য। প্রকাশের শত বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল এই রচনাটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দলিল।[১২]

তথ্যসূত্র

১. কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, সংঘ প্রকাশন, ঢাকা জানুয়ারি ২০১৪ পৃষ্ঠা ৫৯।
২. অনুপ সাদি, ২৭ আগস্ট ২০১৭; “কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত মুক্তির নির্দেশনা” রোদ্দুরে, ঢাকা, ইউআরএল, https://www.roddure.com/encyclopedia/marxist-glossary/on-the-communist-manifesto/
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১১৪।
৪. কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, পূর্বোক্ত,
৫. পূর্বোক্ত,
৬. ভ্লাদিমির সাজনভ, কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ৭০।
৭. ভি আই লেনিন, জুলাই-নভেম্বর, ১৯১৪, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৭।
৮. ভি আই লেনিন, শরতকাল ১৮৯৫, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৪৬।
৯. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৯।
১০. গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯।
১১. ভ্লাদিমির সাজনভ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৮।
১২. সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, ফরাসি বিপ্লবে নিম্নবর্গের মানুষ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ মে ২০০২, পৃষ্ঠা ৭৩।

রচনাকাল: ২৭ আগস্ট ২০১৭,
বুদ্ধনগর, বানেশ্বর, কাঠমান্ডু, নেপাল।

Leave a Comment

error: Content is protected !!