আদিম সাম্যবাদ বা আদি সাম্যবাদী সমাজ বা আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ বা আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ গঠনরূপ (ইংরেজি: Primitive Communism) হচ্ছে কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের কাছ থেকে উদ্ভূত একটি ধারণা। তাঁরা যুক্তি দেন যে ঐতিহ্যবাহী শিকারী-সংগ্রাহক গোষ্ঠী সমাজগুলি সমমাত্রিক সামাজিক সম্পর্ক এবং সাধারণ মালিকানার উপর ভিত্তি করে টিকে ছিল। মার্কসের আর্থ-সামাজিক কাঠামোসমূহের মডেলগুলিতে, আদিম সাম্যবাদের সাথে চলতি সমাজগুলিতে কোনো ক্রমান্বয়িক সামাজিক শ্রেণির গঠন বা পুঁজির সঞ্চয়ন ছিল না।
সমাজতাত্ত্বিক গবেষক, বিশেষ করে মার্কসবাদীদের মতে মানুষের প্রাথমিক সামাজিক সংগঠনের রূপ ছিল যৌথ এবং সাম্যবাদী। জীবন রক্ষার জন্য উৎপাদনের উপায়গুলো তখনো খুবই অনুন্নত। শ্রমের বিভাগও বিকাশ লাভ করে নি। নারী-পুরুষের কাজের মধ্যেও তেমন পার্থক্য সৃষ্টি হয় নি। এই পর্যায়ে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক ছিল অপরিহার্যরূপে সামাজিক ও সমষ্টিগত। উৎপাদনের উপায় অর্থাৎ সুচালো পাথর, বর্শা, বল্লম ইত্যাকার উৎপাদনী যন্ত্রগুলি ছিল গোত্র বা গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি এবং তার ব্যবহার ছিল সমষ্টিগত। উৎপাদিত বা সংগৃহীত খাদ্য সম্পদের ভোগও ছিল সমষ্টিগত।[১]
আদিম সাম্যবাদ এবং এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
মানুষের প্রাথমিক সামাজিক জীবন আদিম সাম্যবাদ যখন চালু ছিল তখন কোনো ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। মানুষ যৌথভাবে বসবাস করতো, দলবদ্ধভাবে খাবার জোগাড় করে যৌথভাবে খেতো। যেদিন খাবার জুটতো সবাই মিলে ভাগ করে খেতো, না জুটলে সবাই না খেয়ে থাকতো। ঝড়-বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যৌথভাবে মোকাবেলা করতো। বনের পশু বা জঙ্গলের কোনো মালিক ছিল না। সবার সমান অধিকার। উৎপাদনের উপকরণগুলি ছিল সমাজের অধিকারে। উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা তখনও আসেনি। কোনো শ্রেণি ছিল না; তাই কোনো শ্রেণি-শোষণও ছিল না। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ছিল না। বিয়ে প্রথাও গড়ে উঠেনি। সেজন্য সন্তান মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতো।[২]
অবশ্য এই সামগ্রিক যৌথ ব্যবস্থার মধ্যেও আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা যে কিছুই ছিল না, এমন নয়। দেহাবরণ অবশ্যই ব্যক্তিগত ছিল। উৎপাদনী যন্ত্র যে আদৌ ব্যক্তিগত থাকতে পারতো না এমনও নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাস্তব পরিস্থিতি এমন ছিল যে, গোত্র বা গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ এবং যৌথ চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত ব্যক্তির পক্ষেও খাদ্য সংগ্রহ করে এবং বৈরী প্রকৃতি ও বন্যপশুর বা প্রতিদ্বন্দ্বী মানবগোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিরোধ করে জীবন রক্ষা সম্ভব ছিল না।[২]
উৎপাদনের উপায়ের যৌথ সম্প্রদায়গত মালিকানা ও শোষণের অনুপস্থিতি, স্বাভাবিক লিঙ্গ ও বয়সের বিভক্তির ভিত্তিতে যৌথ শ্রম, দ্রব্য সামগ্রীর সম বন্টন, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের নিম্ন মাত্রা এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এইরকম যে সমাজ আদিকালে বিরাজমান ছিলো সেই সমাজকেই আদিম সাম্যবাদী সমাজ বলা হয়।[৩]
আদিম সাম্যবাদের ভাঙন
উৎপাদিকা শক্তি ও সামাজিক শ্রমবিভাগের বিকাশের ফলে উদ্বৃত্ত দ্রব্য উৎপাদন সম্ভব হয়ে ওঠে, সম্পত্তি মালিকানায় অসমতা এবং পরবর্তীকালে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ঘটে। গোষ্ঠী ব্যবস্থায় ভাঙন ধরে, বৈরি শ্রেণিসমূহের আবির্ভাব ঘটে, রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।[৩] মাও সেতুং আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা বদলিয়ে দাসব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার, অর্থাৎ একটি শোষণহীন ব্যবস্থাকে বদলিয়ে একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সেই বিপ্লবটাকে “ইতিহাসে নজিরবিহীন” বলে উল্লেখ করেছেন।[৪]
এর পরে সামাজিক পরিশ্রমে বিভাগ শুরু হয়। পশুপালন এবং কৃষিকাজ দুটি আলাদা জীবিকার রূপ গ্রহণ করে। এই বিভাগের ভিত্তিতে সমাজের উৎপাদন ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য-সামগ্রীর পরিমাণের তারতম্যে দ্রব্যবিনিময় শুরু হয় এবং সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাও সম্ভব হতে শুরু করে। কালক্রমে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পরিমাণের পার্থক্যে অসাম্য উদ্ভুত হতে থাকে। গোত্রে গোত্রে লড়াই বা যুদ্ধের পরিণামে পরাজিত গোত্রের মানুষ বিজয়ী গোত্রের দাস বলে গণ্য হয়ে উৎপাদনের এক অভাবিতপূর্ব উপায়রূপে বিজয়ী গোত্রের কাছে কিংবা বিজয়ী গোত্রের শক্তিমান ব্যক্তিদের কাছে দেখা দেয়। এবার সামগ্রিকভাবে সামাজিক কাঠামোতে সাম্যবাদ বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।[২]
দাস এবং উৎপাদনের যন্ত্রাদির ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎপাদন বৃদ্ধির যে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেয় পূর্বকার যৌথ ব্যবস্থাপনার অবস্থিতি যে সম্ভাবনার বিকাশের প্রতিশক্তি বা শৃঙ্খলরূপে কাজ করতে থাকে। হস্তশিল্প থেকে কৃষিকাজের পৃথকীকরণ শ্রমের বিভাগকে বিস্তৃততর করে উৎপাদন ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার পরিণামে আদি সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে শ্রেণি বিভক্ত সমাজের উদ্ভব ঘটে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে দাস ও প্রভুতে বিভক্ত সমাজ জন্মলাভ করে।[২] কোনো কোনো জাতির মধ্যে আদিম গোষ্ঠীভিত্তিক গঠনরূপ বিশশতক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
তথ্যসূত্র:
১. রায়হান আকবর, রাজনীতির ভাষা পরিচয়, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ২৭-২৮।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১১৬-১১৭
৩. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১৬-১৭।
৪. মাও সেতুং, সভাপতি মাও সেতুঙের উদ্ধৃতি ও শেষ জীবনের উদ্ধৃতি, ঐশী পাবলিকেশন্স, ২০১৫
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।