সমাজের উৎপাদিকা শক্তি বা উৎপাদনী শক্তি (ইংরেজি: Productive forces) বলতে উৎপাদনের যন্ত্র, যন্ত্র ব্যবহারের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ এবং শ্রমের স্বভাব বা আগ্রহকে বোঝায়। মার্কসবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বের অন্যতম উপাদান হচ্ছে উৎপাদিকা শক্তি। পণ্যের উৎপাদনযন্ত্র বা মাধ্যম এবং যারা এসব মাধ্যমকে ব্যবহার করে অর্থাৎ শ্রম শক্তির একত্রীকরণ হচ্ছে উৎপাদিকা শক্তি। উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক একযােগে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তােলে।
বিভিন্ন উপাদান নিয়ে যে উৎপাদনী শক্তি তার মধ্যে যন্ত্রব্যবহারকারী শ্রমিকের ভূমিকাই প্রধান। শ্রমিক একদিকে যেমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সম্পদ উৎপাদন করে তেমনি শ্রমের মাধ্যমে যন্ত্রের ক্রমাধিক উন্নতি তারাই সাধন করে, অর্থাৎ যন্ত্রের সঙ্গে শ্রমিকের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতা যন্ত্রের উন্নতির মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। শ্রমশক্তির উৎপাদনী ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধির মূলেও শ্রমিক। মানুষের সমাজের বিশেষ পর্যায়ের উৎপাদনী শক্তির অবস্থা প্রকৃতির উপর সেই সমাজের শক্তির পরিমাণের পরিচায়ক।[২] ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিজমের নীতিমালার ১৬ নং প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন,
সবার চাহিদা অনুসারে যোগান দেবার জন্যে: পর্যাপ্ত সেই পরিমাণ উৎপাদই শুধু নয়, অধিকন্তু সামাজিক পুঁজি বাড়াবার এবং উৎপাদন-শক্তিসমূহের আরও সম্প্রসারের জন্যে আবশ্যক উদ্ধৃত্তি উৎপাদ যতক্ষণ না হয়, ততক্ষণ সবসময়ে থাকেই একটা প্রাধান্যশালী শ্রেণী, যেটা সমাজের উৎপাদনশক্তিসমূহের পরিচালক, আর একটা গরিব উৎপীড়িত শ্রেণি। উৎপাদন বিকাশের পর্বের উপর নির্ভর করে শ্রেণী-দুটোর গড়নের ধরন।
উৎপাদিকা শক্তি প্রতি মুহুর্তেই পরিবর্তিত ও উন্নত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সাধারণত দেখা যায় যে, শ্রমের যন্ত্রের উন্নতি ঘটে প্রথমে। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত যন্ত্রের স্থলে উন্নততর যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। উন্নততর যন্ত্রের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য ভিন্নতর শ্রম বা উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যক হয়। অবশ্য একটিমাত্র উন্নত যন্ত্রের আবিষ্কারেই যে ভিন্নতর উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যক হয় এমন কথা বলা হচ্ছে না। ব্যাপকভাবে যন্ত্রের যখন উন্নতি ঘটে তখন দেখা যায় যে, পূর্বকার উৎপাদন সম্পর্ক যেমন উন্নততর যন্ত্র ব্যবহারে উপযুক্ত নয়, তেমনি পুরাতন সম্পর্কের ভিত্তিতে উৎপাদনও আর বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না।[২]
ফলে পণ্য উৎপাদনের বিকাশ ও উন্নয়নের একটি নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় উপাদান উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সাবেকি উৎপাদন সম্পর্কের সংঘর্ষ বাধে। কারণ ওই উৎপাদন সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপূরকতার পরিবর্তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বৈসাদৃশ্য কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়ােজন হয় সমাজ বিপ্লবের, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন এক উৎপাদন ব্যবস্থা।[১] অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে এরূপ দ্বন্দ্বের নিরসন হয় বিপ্লবের মাধ্যমে নতুনতর উৎপাদন সম্পর্ক এবং সমাজ প্রতিষ্ঠায়।
দ্র. উৎপাদন ব্যবস্থা; উৎপাদন সম্পর্ক; ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫০।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩২০-৩২১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।