দাস সমাজ বা দাসপ্রথাভিত্তিক গঠনরূপ (ইংরেজি: Slavery বা Slave society) হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানা ও মানুষ কর্তৃক মানুষকে শোষণের ভিত্তিতে গঠিত মানব জাতির ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিগতভাবে বৈরি সামাজিক অর্থনৈতিক গঠনরূপ। এই দাসপ্রথাভিত্তিক গঠনরূপের আবির্ভাব হয়েছিল আদিম গোষ্ঠীভিত্তিক গঠনরূপের ভাঙনের ফলে। মানব জাতির প্রথম সামাজিক অর্থনৈতিক গঠনরূপ আদিম যৌথ সমাজ বা আদি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার পরই আসে এই দাস সমাজ ব্যবস্থা। মানব সৃষ্ট এই দাস সমাজেই শ্রেণির ও রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
দাস সমাজে প্রধান শ্রেণিসমূহ ছিল দাসমালিক ও দাসরা, তাদের পাশাপাশি মুক্ত কৃষক, হস্তশিল্পী ও অন্যান্য সামাজিক স্তরও বিদ্যমান ছিল। প্রাচীনতম দাসপ্রথাভিত্তিক রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান মিশরের তৎকালীন মেসোপ্টেমিয়ায়। দাসপ্রথাভিত্তিক গঠনরূপের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে প্রাচীন গ্রিসে এবং প্রাচীন রোমে।[১]
দাস সমাজ আবির্ভাব
কিন্তু কিভাবে দাস সমাজ ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটলো? আদি সাম্যবাদী সমাজে মানুষ যৌথভাবে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে করতে তীর-ধনুক বানাতে, আগুন জ্বালাতে, বন্য জন্তু শিকার এবং খাদ্য দ্রব্য। সংগ্রহ করতে শিখল। এর অনেক পরে লোহা গলিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র তৈরি, খাদ্য। সামগ্রী জন্মাতে শিখল। এভাবে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হলো।[২]
আদিম যৌথ সমাজ বিকাশের একটা স্তরে এসে দেখা গেল, যারা কাজ করে তারা তাদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি জিনিস উৎপন্ন করতো। এই উদ্বৃত্ত জিনিসই সমাজে প্রথমে নিয়ে এলো বিনিময় প্রথা। আর উদ্বৃত্ত জিনিস থেকেই মানুষের মনে ধারণা জন্মালো নিজে কাজ না করে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে উদ্বৃত্তের উপর নির্ভর করে জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়।
খাদ্যের সন্ধানে মানুষ গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, উপজাতিতে উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে ছিল। ধাতু ও খাদ্য দ্রব্য দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক পক্ষ অন্য পক্ষের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। যুদ্ধে পরাজিত যুদ্ধবন্দিদেরকে প্রথমদিকে হত্যা করে ফেলা হতো। কিন্তু যখন দেখা গেল যে মানুষ তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে পারে তখন এই যুদ্ধবন্দিদেরকে দাসে পরিণত করা শুরু হয়, তাদের উদ্বৃত্ত উৎপাদনকে আত্মসাৎ করার জন্য। এভাবে দাসপ্রথা গড়ে ওঠে এবং মানুষের সমাজে শ্রেণিবিভক্তি গড়ে ওঠে।
বিজয়ী গোষ্ঠী এই দাসদের দিয়ে কাজ করাতো এবং ধীরে ধীরে এটাই উৎপাদন প্রথা হয়ে পড়লো। এভাবে আদি সাম্যবাদী সমাজ দাস সমাজে উত্তরণ ঘটায়। এই নতুন সমাজে তখন দুটো মৌলিক শ্রেণির সৃষ্টি হলো– দাস আর দাস মালিক।[২]
দাস সমাজ ভাঙন
ক্রমশ দাসপ্রথাভিত্তিক গঠনরূপ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়; এটা ঘটে মূলত দাসদের উৎসাহ না থাকার ফলে, যারা উৎপাদন বিকাশে যে কোনো ধরনের মালিকানা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এছাড়াও উন্নততর শ্রমের হাতিয়ার ব্যবহারের ফলে। দাসপ্রথাভিত্তিক গঠনরূপের স্থান দখল করে সামন্তবাদ।
তথ্যসূত্র
১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫।
২. রায়হান আকবর, রাজনীতির ভাষা পরিচয়, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ২৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।