সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির মালিকানা প্রতিষ্ঠা

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (ইংরেজি: Socialist Revolution) হচ্ছে পুঁজিবাদের উচ্ছেদের ভিত্তিতে কারখানা, যন্ত্র, জমি এবং প্রাকৃতিক অপরাপর সম্পদের উপর শ্রমিক শ্রেণির সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজের দিকে অগ্রগতি। মার্কস এবং এঙ্গেলস মানুষের সমাজের বিকাশ বিশ্লেষণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে পুঁজিবাদের পরবর্তী স্তরে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। তারা পুঁজিবাদকে বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন যে, পুঁজিবাদের মূল অসঙ্গতি হচ্ছে, একদিকে উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদিত সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং অপরদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার যৌথ চরিত্র। যৌথভাবে যে সম্পদ শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদন করে মালিক শ্রেণি  ব্যক্তিগতভাবে তা ভোগ করে।

পুঁজিবাদ শ্রমিককে পণ্য এবং শ্রমদাস হিসাবে ব্যবহার করে। শ্রমের বাজারে সর্বহারা বুভুক্ষ অসহায় শ্রমিকের সমস্ত শ্রমশক্তি দিন কিংবা সপ্তাহের চুক্তিতে পুঁজি এবং কারখানার মালিক নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে কিনে নেয়। বিনিময়ের চুক্তি মোতাবেক শ্রমিক তার প্রাপ্য মজুরির সমপরিমাণ সম্পদই মাত্র উৎপন্ন করতে বাধ্য। কিন্তু তার অসহায়তার কারণে শ্রমিক তার প্রাপ্য নির্দিষ্ট মজুরির পরিবর্তে অধিকগুণ বেশি সময় পরিশ্রম করে এবং অধিকগুণ বেশি সম্পদ উৎপন্ন করে। মজুরের এই চুক্তি-অতিরিক্ত শ্রমের ফল আত্মসাৎ করেই পুঁজিবাদ তার মুনাফা তৈরি করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এই অসঙ্গত অর্থনীতিক বুনিয়াদকে ভাবগত প্রচারে এবং শাসনের যন্ত্র দ্বারা স্থায়ী করে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু উৎপাদনের যৌথ প্রক্রিয়া সর্বহারা শ্রমিককে একতার শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের শোষণগত বিরোধ ব্যতীত এক পুঁজিবাদীর সঙ্গে অপর পুঁজিবাদীর মুনাফার প্রতিযোগিতা এবং এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে উৎপন্ন দ্রব্য অধিকতর লাভে বিক্রি করার জন্য বিশ্ববাজার দখল এবং বণ্টনের উপর অপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরোধও বিদ্যমান। এই সমস্ত বিরোধের পরিণামে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অপরিহার্য বলে মার্কস এবং এঙ্গেলস অভিমত প্রকাশ করেন।

পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরকে বিশ্লেষণ করে লেনিন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অত্যাসন্নতার কথা বলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূত্রসমূহের উল্লেখ করে লেনিন বলেন : ১. পুঁজিবাদের অসমান বিকাশের কারণে শ্রমিক শ্রেণি সাম্রাজ্যবাদের এবং পুঁজিবাদের দুর্বল অংশ বা এলাকায় আঘাত করে এক কিংবা একাধিক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত স্থানে একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘঠিত হবে এমন কোনো কথা নাই ; ২, পৃথিবীর দেশ বা অংশবিশেষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলে পৃথিবীতে পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র এই উভয় ব্যবস্থার সহঅবস্থানের প্রশ্নটি জন্মলাভ করবে; ৩. শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বেই মাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে; ৪. বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র উচ্ছেদ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারার একনায়কত্ব অপরিহার্য ; ৫. সাম্রাজ্যবাদের সংকটকালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সর্বহারা মুক্তিকামী পরাধীন জাতির মুক্তি আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে এবং মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণীর এই ঐক্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য নিশ্চিত করে তোলে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করতে পারে লেনিন তারও উল্লেখ করেন।

আরো পড়ুন:  এক দেশে সমাজতন্ত্র হচ্ছে লেনিন উদ্ভাবিত তত্ত্ব যা স্তালিন ও ত্রতস্কির বিতর্কে রূপ পায়

সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ পর্যুদস্ত করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বিজয় লাভ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে বহু জাতির জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন এবং পূর্ব-ইউরোপের কয়েকটি দেশে, চীনে এবং কিউবায় সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের নিশ্চয়তা বিধানকারী নয়া-গণতান্ত্রিক বা জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সুনিশ্চিত করে তুলেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা শ্রমিক শ্রেণির হস্তগত হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটা প্রক্রিয়াবিশেষ এবং সম্পূর্ণ হওয়া সময়সাপেক্ষ। সমাজতন্ত্র উৎপাদনের এবং বন্টনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হলে সাম্যবাদী সমাজ বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে। সাম্যবাদী সমাজে প্রতিটি মানুষ যেমন তার ক্ষমতা অনুযায়ী সমাজের জন্য শ্রম করবে তেমনি সমাজও তার সমস্ত প্রয়োজনকে পূরণ করবে।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩৩৭-৩৩৮

Leave a Comment

error: Content is protected !!