ত্রি-বিশ্ব তত্ত্ব বা তিন বিশ্ব তত্ত্ব (ইংরেজি: Three Worlds Theory) হচ্ছে মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর চীনা সংশােধনবাদী পার্টির পক্ষ থেকে প্রচারিত শ্রেণি সমন্বয়বাদী বিপ্লব বর্জনকারী তত্ত্ব। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ত্রি-বিশ্ব তত্ত্ব তিনটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্বের প্রস্তাব দেয়। ১৯৭৪ সালে, জাতিসংঘে উপ-প্রধানমন্ত্রী দেং জিয়াওপিং অ-কমিউনিস্ট দেশগুলির সাথে গণচীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ব্যাখ্যা করার জন্য, কাঁচামাল এবং বিকাশের সমস্যাগুলি সম্পর্কে নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উপস্থাপনার সময় ত্রি-বিশ্ব তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন।[১]
মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পর চীনা সংশােধনবাদী পার্টির পক্ষ থেকে ত্রি-বিশ্ব বা তিনবিশ্ব তত্ত্বের প্রচার ব্যাপকভাবে চালানাে হয়। চীনা পার্টির প্রতিবিপ্লবী অবৈধ কুচক্রী নেতা দেং জিয়াওপিং তৎকালীন বিশ্বটাকে এভাবে দেখায়, মার্কিন ও সােভিয়েত রাশিয়া এই দুই আধিপত্যবাদী শক্তি হচ্ছে প্রথম বিশ্ব। জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, বৃটেনসহ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলাে হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব। চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ও অনুন্নত দেশগুলাে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব।
দুই পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ হলাে তৃতীয় বিশ্বের দেশ, জাতি ও জনগণের প্রধান শত্রু, যার মাঝে আবার সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ হলাে প্রধান বিপজ্জনক। এই প্রধান শত্রু, দুই পরাশক্তির আধিপত্যবাদ বিরােধী সংগ্রামের প্রধান শক্তি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব। দুই পরাশক্তির দ্বারা দ্বিতীয় বিশ্বের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও হুমকির সম্মুখীন। যার ফলে প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বকেও মিত্র হিসেবে কাছে টানতে হবে এবং তাদের সাথে ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে।
এই ছিল ত্রি-বিশ্ব তত্ত্বের সার কথা। যাকে তারা বিশ্ব রণভূমে বিপ্লবের রণনৈতিক লাইন আকারে প্রচার করে। চীনের নয়া সংশােধনবাদীরা তখন মাও-এর বিপ্লবী লাইনকে বর্জন করা সত্ত্বেও শঠতার সাথে মাও সেতুংয়ের নাম ব্যবহার করছিল। এবং তারা মিথ্যা প্রচার চালায় যে, এ তত্ত্ব নাকি মাও কর্তৃক প্রণীত।
বাস্তবে এটি ছিল মাও-লাইন বিরােধী একটি তত্ত্ব। মাও-এর জীবিতাবস্থায় চীনা পার্টি বা মাও কোনাে পক্ষ থেকেই এ ধরনের রণনৈতিক তত্ত্বের কথা শােনা যায়নি। তবে মাও সর্বদাই শত্রুর মধ্যকার বিভাজনকে কৌশলগতভাবে গুরুত্ব দিতেন। তদুপরি, চীনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর পররাষ্ট্রনীতির বিবিধ প্রশ্নে মাও-এর দ্বারা অনুসত বা অনুমােদিত কিছু পলিসি কাজ করতাে, যেমন, পঞ্চশীলা নীতি।
তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে দুই পরাশক্তির আধিপত্যবাদকে বিশ্বজনগণের প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করা, অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে তাদের ফাটল ও দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করা, প্রধান শত্রুর সাথে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানাে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে, বিশেষত সােভিয়েত সামরিক হুমকির মুখে চীনের সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করা, প্রধান শত্রুদেরকে কোনঠাসা করা বিভক্ত করা ও বিচ্ছিন্ন করা এবং বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের স্বার্থে এই দ্বন্দ্বগুলােকে ব্যবহার করার সঠিক পলিসি চীনা পার্টির ছিল। সুতরাং এই ধরনের অবস্থান থেকে বিশ্বকে তিনভাগে বিভক্ত করাটা মাওপন্থী কাজ ছিল।
কিন্তু তার অজুহাতে সর্বহারা বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের অধীনস্ত করে ফেলাটা ছিল তেঙ চক্রের কাজ। এবং সেটা করার জন্য ২য় ও ৩য় বিশ্বের রাষ্ট্র, শাসকশ্রেণি ও সরকারের সাথে সেসব দেশের জনগণকে একাকার করে ফেলার মাধ্যমে বিপ্লব বর্জন করার ত্রি-বিশ্ব তত্ত্ব যে নির্জলা শ্রেণি-সমন্বয়বাদী ও সংশােধনবাদী তত্ত্ব ছিল তাতে কোনাে সন্দেহ ছিল না।[২]
সারা বিশ্বের মাওবাদী বিপ্লবীরা অত্যন্ত ঘৃণাভরে এ তত্ত্বকে শ্রেণিসমন্বয়বাদী ও বিপ্লব বর্জনকারী তত্ত্ব হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। তারা দেখান যে এটা ছিল তেঙ লাইন। তারা এর বিপরীতে মাও-লাইনকে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
তথ্যসূত্র
১. দেং জিয়াও পিং, ১২ এপ্রিল ১৯৭৪. “Excerpts From Chinese Address to U. N. Session on Raw Materials; Plundering, Bullying’ High-Handed Measures’ Independent Development”. ইউআরএল: https://www.nytimes.com/1974/04/12/archives/excerpts-from-chinese-address-to-u-n-session-on-raw-materials.html; The New York Times. সংগৃহীত, ১৯ আগস্ট ২০২০
২. রায়হান আকবর, রাজনীতির ভাষা পরিচয়, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ২২-২৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।