ইহুদি বিদ্বেষ হচ্ছে জাতিবিদ্বেষমূলক আন্দোলন

ইহুদি বিদ্বেষ (ইংরেজি: Antisemitism বা anti-semitism or anti-Semitism) হচ্ছে রাজনীতিতে কুখ্যাত জাতিবিদ্বেষমূলক আন্দোলন। আধুনিককালে তার সূত্রপাত ঘটে ঊনিশ শতক থেকে ইউরােপে ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। সমগ্র মধ্য যুগে ইহুদিরা ধর্মীয় কারণে প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হত, বিশেষ করে তারা সুদি কারবার করত বলে।[১] 

বর্তমানকালে রাজনৈতিক, অর্থনীতিক ও মতাদর্শগত কারণে ইহুদি বিদ্বেষের ধরন পালটে গেছে; কতকগুলি মিথ্যা বৈজ্ঞানিক যুক্তি খাড়া করেছে কিছু ইহুদি বিদ্বেষী লেখক ও নাৎসি দর্শনবেত্তারা। উনিশ শতকের সত্তরের দশকে জার্মানির একটি লেখক গােষ্ঠী ভাষাতত্ত্বের ‘সেমিটিক’ ও ‘আর্য’ শব্দ দুটির পার্থক্যকে জাতিগত প্রত্যয়ে অপব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করে যে ইহুদিরা হলো একটি স্বতন্ত্র ও নিচু জাত বা নরগােষ্ঠী। আশির দশকে জার্মানি ও অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিতে ইহুদি বিরােধী নানা রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। সে সময়ে রাশিয়ায় ইহুদিদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ (pogrom) দেখা দেয়।[১]

উনিশ শতকের শেষদিকে ও বিশ শতকের গােড়ায় ইহুদিরা দলে দলে দেশ ছেড়ে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়, ক্রমে ফ্রান্স, লিথুয়ানিয়া ও পােল্যান্ডে সেই ইহুদি বিদ্বেষী আন্দোলনও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ খ্রি পর্যন্ত হিটলার আর্যদের উচ্চ জাতি বলে এক নতুন তত্ত্ব খাড়া করেন এবং জামনির দুর্গতির জন্য ইহুদিদের দায়ী করেন। সেই কারণে নাৎসি জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিধিবদ্ধ নুরেমবার্গ আইন (১৯৩৫) অনুযায়ী ইহুদিদের জার্মান নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় ও আর্যদের সঙ্গে তাদের বিবাহ নিষিদ্ধ হয়; ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইহুদিদের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা শুরু হয়।

১৯৩৯ সালে হিটলার বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালে জার্মানির অভ্যন্তরে ইহুদি নির্যাতন চরম আকার গ্রহণ করে। সমস্ত ইহুদি সম্প্রদায়কে বলশেভিক বা সাম্যবাদের অনুচর আখ্যা দেওয়া হয় এবং নাজিরা ব্যাপকভাবে ইহুদিদের গ্রেপ্তার করে বন্দি নিবাসে প্রেরণ করতে থাকে এবং লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে নির্বিচারে হত্যা করে। এরূপ পরিবেশে আইনস্টাইনের ন্যায় যে সমস্ত ইহুদি বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক জার্মানি থেকে পালায়ন করে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন কেবল তাঁরা এই নিধনযজ্ঞ থেকে রেহাই পান।[২] দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময়ে ৫০ লক্ষ ইহুদিকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন দেশে ইহুদি স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন ও ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ইহুদি বিদ্বেষ নতুন আকার নেয়।

আরো পড়ুন:  জৈন মতবাদ ধর্মীয় ও তত্ত্বগতভাবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতবাদ

ইহুদি বিদ্বেষের ইতিহাস দীর্ঘ এবং তার রকমফের আছে। নাৎসিরা ইহুদিদের সঙ্গে আর্যদের জাতিগত, রক্তগত ও চরিত্রগত পার্থক্যের তত্ত্ব প্রচার করে। তাদের উপর নাৎসিরা ধূর্তামি, লােভ, শক্তিমত্ততা, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি দোষ আরােপ করে; নাৎসিদের প্রচারে ইহুদিরা হলো সুদখাের ও অত্যাচারী। তবে ইহুদি বিদ্বেষের সঙ্গে ইহুদিদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের ধর্মের বিরােধ স্বতন্ত্র। ইহুদিরা যিশু খ্রিস্টকে অস্বীকার করে, তবে যারা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে বিরােধ মিটে যায়। ইহুদি বিদ্বেষ সম্পর্কে নানারকম ব্যাখ্যাও আছে। যেমন, ঋণদাতার বিরুদ্ধে ঋণগ্রহীতার বিদ্বেষ আবহমানকালের। ইজরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বিশ্বের মুসলমানদের মনে ইহুদি বিদ্বেষ বদ্ধমূল হয়ে গেছে।[১]

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪৭।

২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৬৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!