পাগলামী বা মানসিক রোগ হচ্ছে ব্যক্তির ক্রিয়াকর্মে নিয়ন্ত্রণক্ষমতার হ্রাস বা অভাব

বাতুলতা, পাগলামী, মানসিক অসুস্থতা কিংবা পাগলামোর (ইংরেজি: Insanity, madness, বা craziness) সূচনা বা উহার সীমা নির্দিষ্ট করে সংজ্ঞা দান করা কঠিন। কারণ মানসিক অসুস্থতা কেবল মন কিংবা কেবল দেহের ব্যাপার নয়। মানসিক রোগ বা অসুস্থতার প্রধান লক্ষণ ব্যক্তির জাগতিক ক্রিয়াকর্মে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণক্ষমতার হ্রাস কিংবা অভাব। জাগতিক উদ্দীপকের জবাবে মানুষ যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সে সমস্ত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা পারম্পর্য এবং সম্পর্ক বিদ্যমান। এই পারম্পর্য এবং সম্পর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি বা বিবেচনার ফল। ব্যক্তির মন বা মস্তিষ্ক কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্ত উদ্দীপকের বিবেচনা করে এবং তার জবাবে নিজের জীবন ও স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভাব ঘটলে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ামূলক জবাবের মধ্যে আর শৃংখলা, ভারসাম্য এবং আত্মস্বার্থমূলক চিন্তার লক্ষণ থাকে না। অবশ্য শৃঙ্খলা, ভারসাম্য প্রভৃতি বিষয়গুলি আপেক্ষিক।

ব্যক্তির সামাজিক আচরণের যদি কোনো আদর্শ মান স্থির করে তাকে ‘স্বাভাবিক’ বলা যায় তা হলে তার বিচারে যে কোনো ব্যক্তির কোনো না কোনো আচরণকে ‘অস্বাভাবিক’ বলা যাবে। এজন্য পাগলামি বা মানসিক রোগের লক্ষণ যদি ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ হয় তা হলে মানুষমাত্রই আপেক্ষিকভাবে কম কিংবা অধিক মাত্রায় অস্বাভাবিক অর্থাৎ পাগল। সাধারণত যে ব্যক্তির আচরণ সমাজের অপর দশজনের চোখে অত্যধিক অস্বাভাবিক বলে বোধ হয় তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করা হয়।

পাগলামির কারণের গবেষণা চিকিৎসাশাস্ত্র এবং মনোবিজ্ঞানে দীর্ঘকাল যাবত চলে আসছে। চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির পূর্বে সাধারণ ধারণা ছিল যে পাগলামির কারণ অতি-প্রাকৃতিক এবং দেহের বাইরের কোনো অশরিরী অশুভ শক্তি ব্যক্তির উপর ভর করে তার সমস্ত আচরণ অস্বাভাবিক করে তোলে। এ কারণে অতীতে পাগলামি থেকে রোগীকে নিরাময় করার প্রধান পদ্ধতি হিসাবে মানুষ জাদু, মন্ত্র ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করত। পরবর্তীকালে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষয় কিংবা ক্ষতির মধ্যে নির্ধারিত করার চেষ্টা করা হয়।

আরো পড়ুন:  বিজ্ঞান বস্তু ও চিন্তনের প্রক্রিয়া, ব্যাখ্যা, গুনাগুণ, সম্পর্ক ও নিয়মাবলী অধ্যয়ন করে

চিকিৎসকগণ বলেন যে, মস্তিষ্কের করটেক্স বা বহিঃস্তরে আঘাতের ফলে কিংবা বিষাক্ত রক্তের কারণে ক্ষতি সাধিত হলে ব্যক্তির চেতনায়ও নানা প্রকার বিভ্রান্তি বা বিকারের সৃষ্টি হয়। এরূপ বিকারেই মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়। এরূপ বিকারকেই মানসিক রোগ বলে। আসলে মানসিক বা মনের রোগ বলে কিছু নেই। সবই ঘটে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষ করে মস্তিষ্কের ক্ষয়ক্ষতির ফলে। কিন্তু এই অভিমত মনোবিজ্ঞানীগণ সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন না।

মনোবিজ্ঞানে মনের অস্তিত্বের উপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করেন বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)। তিনি মানসিক রোগের উপর গবেষণা করেন এবং তার গবেষণার তত্ত্ব মনোসমীক্ষণ নামে পরিচিত। ফ্রয়েড এই অভিমত পোষণ করেন যে, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মস্তিষ্কের কোষসমূহ স্বাভাবিক থাকলেও মানসিক বিকারের উদ্ভব ঘটতে পারে। এর কারণ মানুষের মন আছে এবং মন হচ্ছে মানুষের জীবন যাপনের এবং সুখলাভের জন্য কামনা বাসনার সমষ্টি। মানুষের মন চেতন এবং অচেতনে বিভক্ত। সামাজিকভাবে অবাঞ্চিত কামনা নিয়ে ‘অচেতন’ তৈরি। ‘অচেতন’ ভাগের আত্মতৃপ্তি লাভের প্রচেষ্টা এবং সচেতন মন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রয়াসে মানুষের মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা ব্যক্তির চরিত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে ব্যক্তিকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে তোলে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ফ্রয়েড তাই মানসিক রোগের নিরাময়ের জন্য দেহের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ঔষধযোগে নিরাময়ের পরিবর্তে মনের দ্বন্দ্ব নিরসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তার উপযুক্ত উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। এই উপায়ের মধ্যে ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ অন্যতম।

পাগলামির প্রধান লক্ষণ হিসাবে ব্যক্তির মধ্যে ডেল্যুশন বা বিশ্বাসভ্রম, হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিভ্রম, অপরকে অকারণে দৈহিকভাবে আঘাত কিংবা নিজের আত্মহত্যার চেষ্টা প্রভৃতি আবেগমূলক আচরণ উল্লেখ করা যায়। রোগের আর একটি লক্ষণ হচ্ছে, রোগী কোনো বিষয়ের উপর সামান্যতম মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারে না। সে প্রতি মুহুর্তে বিষয় হতে বিষয়ান্তরে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার এমন ও হতে পারে যে, রোগী আপাতঃদৃষ্টিতে এত গভীরভাবে আত্মবিলীন হয়ে থাকে যে তার মনোযোগ কোনো উদ্দীপক দ্বারাই আকৃষ্ট করা সম্ভব হয় না।

আরো পড়ুন:  কার্ল মার্কসের সমাধিপার্শ্বে বক্তৃতা

স্মৃতি-ভ্রংশ কিংবা স্মৃতির পরস্পর বিচ্ছিন্ন খন্ডে খন্ডিত হয়ে যাওয়া মানসিক রোগের অপর একটি সাধারণ লক্ষণ। মানসিক রোগের মূলে দৈহিক কোনো ক্ষতি থাকে কিনা সে সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকেই বলা চলে মানসিক অসুস্থতা নানা প্রকার দৈহিক অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি করে। মানসিক বিকার রোগীর নিদ্রাল্পতা বা নিদ্রাহীনতা, ধমনীর দ্রুতগতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর রোগীর নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতার মাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২২৮-২২৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!