সর্বপ্রাণবাদ বা আত্মাবাদ (ইংরেজি: Animism) হচ্ছে মানব-বিহীন সত্ত্বা যেমন প্রাণী, উদ্ভিদ এবং প্রাণহীন বস্তু বা ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুতে আধ্যাত্মিক নির্যাস বিরাজিত থাকা। অন্য কথায়, প্রকৃতির সব কিছুকেই সপ্রাণ মনে করা, সব ক্রিয়াকলাপের পেছনে প্রাণের অস্তিত্বকে অনুভব করাই হলো সর্বপ্রাণবাদ। আত্মার নিজস্ব থাকার অভিমতকে ‘আত্মাবাদ’ বলা চলে। এই অর্থে ‘আত্মাবাদ’ মানুষের প্রাচীনতম অভিমতগুলির অন্যতম। মানুষের নিজের চেতনাকে গোটা প্রকৃতির উপর আরোপ করার মধ্যেই সর্বপ্রাণবাদের বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে। যে অর্থে মানুষ জীবন্ত ও সংবেদী, সেই অর্থে বিশ্বচরাচরের সমস্ত বস্তুজগতই তার কাছে জীবন্ত ও চেতনাসম্পন্ন।[২]
ইংরেজি Animism শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সর্বপ্রাণবাদ। লাতিন anima বা Animus শব্দের অর্থ শ্বসন, আত্মা বা জীবন থেকে Animism শব্দটি এসেছে। আত্মা ও অধাত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস হচ্ছে যে কোনো ধর্মের একটি আবশ্যিক উপাদান।[১] সমস্ত জড় বস্তুজগতকে সপ্রাণ মনে করার স্তরকে Animatism বা প্রথম সর্বপ্রাণবাদ, তা থেকে পাহাড়, নদী, গাছপালা, জীবজন্তু সব কিছুকেই আত্মা-আশ্রিত মনে করা হলও Animism বা পূর্ণাঙ্গ সর্বপ্রাণবাদ বা আত্মাবাদ। উৎপাদনের অনুন্নত এবং প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ যখন প্রকৃতির নিকট অসহায় ছিল তখন বাঁচার প্রয়োজনে প্রাকৃতিক নানা রহস্যের সন্ধান পাবার সে চেষ্টা করেছে। সে দেহ কিছুকাল পূর্বেও সচল ছিল সে দেহ মৃত্যুর কারণে এখন নিশ্চল। তা হলে মৃত্যু কি? মানুষ ভেবেছে, মৃত্যু হচ্ছে দেহ থেকে আত্মার তিরোধান।
আদিকাল থেকে কথাটা আজো আমাদের মধ্যে চলে আসছে। এখনো আমরা মৃত মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করি। মানুষ নিদ্রা যায়। তখন আত্মা দেহে থাকে না। তাই মানুষের চেতনা থাকে না। কিন্তু আবার আত্মা দেহে প্রত্যাবর্তন করে। দেহে তাই চেতনার সঞ্চার হয়। মৃত্যুকালেও আত্মা দেহ ছেড়ে প্রস্থান করে। যে আত্মা আজ প্রস্থান করেছে, সে কাল হয়তো ফিরে আসবে। তাই প্রাচীনকালে মানুষ মৃতদেহ কবরে রেখে আসার সময়ে আত্মার জন্য প্রয়োজনীয় সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রীও রেখে আসত। আত্মা যখন আবার ফিরবে তখন সে নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত থাকবে। ক্ষুধার্ত আত্মা যেন নিরন্ন, উপবাসী না থাকে, তাই এই ব্যবস্থা। [৩]
আত্মা একবার প্রস্থান করলে সহজে আবার না-ও ফিরতে পারে। সে পথে-বিপথে ঘুরে বেড়াতে পারে। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন রয়েছে। তাই ভারত মহাসাগরে ‘বিপদ-দ্বীপে’র মানুষ এখনো বিভ্রান্ত আত্মাকে ধরার জন্য ফাঁদ ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। আত্মা যে-কোনো দেহ বা বস্তুতেই আশ্রয় নিতে পারে। যে- আত্মা মানুষের ছিল, সে-আত্মা স-জীব, যে-কোনো আধারে প্রবেশ করতে পারে। তাই ইট, পাথর, গাছ, লতা-পাতা, আকাশ, বাতাস, গ্রহ, নক্ষত্র সব কিছুরই আত্মা আছে। এ-কারণেই এ তত্ত্ব সর্বপ্রাণবাদ বলেও পরিচিত। জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের মূলেও এই বিশ্বাস।[৩]
আত্মার স্বাধীন অস্তিত্ব ধর্মীয় বিশ্বাসেরই অপরিহার্য অংশরূপে স্বীকৃত। এই বিশ্বাস থেকে দেবদূত, ভূত, প্রেত ইত্যাদি অস্তিত্বের কথাও মানুষ কল্পনা করেছে। অশান্ত, বিভ্রান্ত কিংবা দুষ্ট আত্মাকে জয় করার প্রয়োজনে মানুষের আদিম অবস্থায় তুক-তাক মন্ত্র বা জাদুবিদ্যার উদ্ভব হয়েছে। সর্বপ্রাণ এবং সর্বপ্রাণবাদ বা আত্মাবাদ মানুষের আদিম সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন।
মানুষের কল্পলোকে সর্বপ্রাণবাদের দোলায় সব থেকে বেশি আন্দোলিত হয়েছে। বিচিত্র পথে এ অনুভূতি আত্মপ্রকাশ করেছে। নিজের চেতনার রঙে প্রকৃতিকে চেনা, নিজের জীবনধর্ম প্রকৃতিতে প্রতিষ্ঠা করা খুবই স্বাভাবিক। সবকিছুকে আত্মাযুক্ত, প্রাণসম্পন্ন রূপে দেখার মধ্যে ধর্মবোধের লক্ষণ থেকে অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণের মানসিকতাই বেশি পরিস্ফুট।[২]
স্যার এডওয়ার্ড টেইলরকে সাম্প্রতিককালের সর্বপ্রাণবাদের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা গঠনের জন্য দায়িত্বশীল মনে করা হয়। তাঁর বিখ্যাত ‘প্রিমিটিভ কালচার’ পুস্তকে সর্বপ্রাণ এবং আত্মাবাদের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. ভাসিলি ক্রাপিভিন; দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কী; প্রগতি প্রকাশন; মস্কো; পৃষ্ঠা ৩৬০; প্রকাশকাল, ১৯৮৯।
২. সমীরণ মজুমদার, সামাজিক বিভাজনের রূপ ও রূপান্তর; নান্দীমুখ সংসদ, ২০০৩; পৃষ্ঠা-৩২, মধ্যাংশ।
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৫৮-৫৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।