জ্ঞান প্রক্রিয়া বা সংজ্ঞান (ইংরেজি: Cognition) হচ্ছে “চিন্তাধারা, অভিজ্ঞতা এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞান এবং বুদ্ধি অর্জনের মানসিক পদক্ষেপ বা প্রক্রিয়া”। জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া বিদ্যমান জ্ঞান ব্যবহার করে এবং নতুন জ্ঞান উৎপন্ন করে।
‘আমাদের জ্ঞান আছে, আমরা জ্ঞান আহরণ করি’ ইত্যাদি কথা আমরা সব সময়ই ব্যবহার করি। জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ আদিকাল থেকে নিজের জীবন রক্ষা করে এসেছে, প্রকৃতিকে সে জয় করে চলেছে এবং মানুষের সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। জ্ঞান বাদে মানুষ নাই। কিন্তু মানুষ কি করে জ্ঞানলাভ করে একটি দর্শনের একটি বিশেষ আলোচনার বিষয়।[১]
জ্ঞানের সমস্যার ক্ষেত্রে ভাববাদী দার্শনিক জর্জ বার্কলির মত খুব পরিচিত। তিনি এরূপ মত প্রকাশ করেছিলেন যদিচ মানুষ বস্তু জগৎকে জানে বলে স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয়, তবু যুক্তিগতভাবে মানুষ বস্তুকে আদৌ জানতে পারে না। মানুষ কেবল তার মনের ভাবকেই জানে। বস্তু কথাটিও মানুষের মনের ভাব। বস্তুর অস্তিত্ব মানুষের মন জানতে পারে না। মানুষের জ্ঞান কতকগুলি প্রধান এবং অপ্রধান ধারণা দ্বারা গঠিত। প্রধান বা মৌল ধারণাগুলি বিশ্বচরাচরের বিধাতা মানুষের মনে সৃষ্টি করেদেন। সেগুলির ভিত্তিতেই মানুষ তার জ্ঞানের জগৎ তৈরী করে।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ জ্ঞানপ্রক্রিয়ার এই ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করে। এই মতানুযায়ী মানুষের জ্ঞান হচ্ছে বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের ফল। মানুষ তার জন্ম থেকে জৈবিক তাড়নাতেই বাইরের বস্তুকে নিজের জীবনের স্বার্থে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে আসছে। বস্তুকে সে নিজের হাতে-পায়ে চোখে-কানে অনুভব করছে। এই প্রক্রিয়ায় বস্তু মানুষের দেহে এবং মস্তিষ্কের কোষে বিভিন্ন সাড়ার সৃষ্টি করেছে। এই মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক বিকাশলাভ করেছে। মানুষের মধ্যে বস্তু সম্পর্কে অনুধাবনের, ব্স্তুর উপর গুণ আরোপ করার এবং গুণের সাহায্যে বস্তুকে স্মরণ রাখার শক্তি জন্মেছে। বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের এই জটিল সম্পর্কই যেমন জ্ঞানের প্রক্রিয়া তেমনি এই প্রক্রিয়া থেকেই মানুষের জ্ঞানের সৃষ্টি।
জ্ঞান বিধিদত্ত কোনো সম্পদ নয়। জ্ঞানকে মানুষই সৃষ্টি করেছে এবং করছে। বস্তু-বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান এবং জগৎ বলে কিছু নেই। মানুষের জ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে বাস্তব জগতের রহস্য উদঘাটন করা। বাস্তবকে জেনে জীবন রক্ষার স্বার্থে তাকে ব্যবহার করা, পরিবর্তন করা। জ্ঞান কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। জ্ঞানের প্রশ্নের মানুষের সঙ্গে তার বাস্তব জগতের সক্রিয় সম্পর্ক সর্বদাই জড়িত।
মানুষের বাস্তব জগৎ আর্থিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো হিসাবে সংঘটিত। মানুষের জ্ঞানও তাই তার আর্থিক সামাজিক অবস্থার দ্বারা একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রিত অপরদিকে তেমনি মানুষের জ্ঞান দ্বারা বিশেষ পর্যায়ের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামো নিজেও নিয়ন্ত্রিত। ব্যবহার বাদে জ্ঞান অর্থহীন। মানুষ সতত যেমন তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করছে তেমনি নিয়ত সেই জ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা তার পরিবেশকে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য পরিবর্তিত করার চেষ্টা করছে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১১৩
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।