ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি অর্চনা (ইংরেজি: Cult of Personality) হচ্ছে মহান মার্কসবাদী লেনিনবাদী শ্রমিক এবং কৃষক নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী গণবিরোধী প্রচারমাধ্যমের বিরামহীন মিথ্যাচার। ইউরো-মার্কিনপন্থী খুনে আধুনিক বর্বরতার প্রচারকারী বিবিসি সিএনএন অবিরাম মার্কসবাদীদের সম্পর্কে ব্যক্তিপুজার অভিযোগ বর্ষণ করে।
সাম্রাজ্যবাদী পরপীড়নের সমর্থক প্রচারমাধ্যম বলে থাকে যে, রাজনীতিক দল কিংবা আন্দোলনের মধ্যে জনপ্রিয় নেতা নিজের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সচেতনভাবে অপর সকলকে মোহগ্রস্ত এবং বাধ্য করার চেষ্টা করলে ব্যক্তিত্বের পূজা বা ব্যক্তিঅর্চনা বা ব্যক্তিত্বের বিকার জন্মলাভ করে। আধুনিককালের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংগঠিত দলের যে অসীম ক্ষমতা, তাতে দলের জনপ্রিয় নেতার মধ্যে এই ত্রুটি প্রকাশের বিশেষ সম্ভাবনা থাকে।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মৃত্যুর পরে স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত সংগ্রামী সংগঠন। কেন্দ্রিয় কমিটি এবং যৌথ নেতৃত্বের ভিত্তিতে এই দল পরিচালিত হলেও দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্টালিন তাঁর সুদৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে নিজেকে অস্বাভাবিকভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন। ক্রমান্বয়ে দলে যৌথ নেতৃত্বের বদলে দলের অনুসারীগণ সকল সাফল্যের মূল হিসেবে স্ট্যালিনের স্তুতিবাদ শুরু করেন।
জোসেফ স্তালিনের জীবিতাবস্থায় সমালোচনা করার সাহস পাননি নিকিতা ক্রুশ্চেভ। স্তালিনের মৃত্যুর পরে অনুষ্ঠিত পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ক্রুশ্চেভ স্টালিনের ব্যক্তিত্বের তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের চূড়ান্ত দিনে ‘ব্যক্তিপূজা এবং এর ফলাফলের ধরন’ সম্পর্কে নিকিতা ক্রুশ্চেভের গোপন ভাষণে এই শব্দটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। তিনি এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, স্তালিন তাঁর নিজের একক নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য সংগঠনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি লংঘন করেছেন এবং অমানুষিক দমননীতি প্রয়োগ করে বহুদলীয় কর্মী এবং নেতার অভিমত স্তব্ধ করেছেন-এমনকি তাঁর নির্দেশে অন্যায়ভাবে অন্যায়ভাবে অনেকের জীবন নাশ করা হয়েছে। ক্রুশ্চেভের এই সমালোচনায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। যাকে এতদিন প্রায় অভ্রান্ত মনীষী বলে বিশ্বের কমিউনিস্ট অনুসারীগণ ভক্তি ও শ্রদ্ধ করে আসছিল ক্রুশ্চেভের বর্ণনায় তিনি অমানষিক নির্যাতনকারী এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিকারগ্রস্থ ডিক্টেটর বলে প্রতিভাত হন।
বস্তুত স্তালিনের মৃত্যুর পরে তাঁর এরূপ সমালোচনা একদেশদর্শী এবং প্রতিপক্ষের জবাবহীন সমালোচনা ছিল। এই সমালোচনায় বৈজ্ঞানিক ভারসাম্যের অভাব ছিল। কিছুকাল পরে ক্রুশ্চেভও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব হতে অপসারিত হন। কারণ কমিউনিস্ট অনুসারীগণ ব্যক্তিত্ববাদের সমালোচনাকারী ক্রুশ্চেভের চরিত্রের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাসী এবং মোহবিস্তারকারী প্রগলভতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অন্যান্য লক্ষণের প্রকাশ দেখতে শুরু করেছিলেন। সোভিয়েত রাষ্ট্রের রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের সাম্প্রতিককালে স্ট্যালিনের যথাযথ মূল্যায়নের চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে স্ট্যালিনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সঠিক নেতৃত্বদান ও বিজয় অর্জন পর্যন্ত স্ট্যালিনের চরিত্রে মারাত্মক কোনো ত্রুটি দেখা দেয় নি। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তীকালে স্ট্যালিনের চরিত্রে অভ্রান্তি এবং বিরাটত্বের ত্রুটি প্রকাশ পেতে আরম্ভ করে।
স্তালিনের একদেশদর্শী সমালোচনার মূলে ছিল সমাজতন্ত্রের আদর্শকে আঘাত করার একটি গূঢ় ইচ্ছা। এই ইচ্ছার পরবর্তী প্রকাশ ঘটে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতন্ত্রের বিরোধী শক্তির সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণে। এর পরিণতিতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতন সংঘটিত হয় নব্বই এর দশকে।
তথ্যসূত্র
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৩০৮-৩০৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।