অদৃষ্টবাদ বা দৈববাদ হচ্ছে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই জীবনের ঘটনা

মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ সংঘটিত হয়, এরূপ বিশ্বাসকে অদৃষ্টবাদ বা দৈববাদ (ইংরেজি: Fatalism) বলে। প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে এই ধারণা এরূপ ব্যাপক ছিল যে, কেবল মানুষ নয়, অলিম্পিয়া পাহাড়ের অধিবাসী দেবতাগণও স্বাধীন নয়। তাদের জীবনও ঊর্ধ্বতর অপর কোনো শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস একটি সাধারণ এবং প্রায় সর্বজনীন বিশ্বাস।

দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে না হলেও সাধারণ মানুষ মনে করে মানুষের জন্ম, মৃত্যু, যুদ্ধ, ঝড়, ঝঞ্ঝা, দুর্যোগ, সামাজিক বিপ্লবের ন্যায় বিরাট ঘটনাসমূহ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা তার কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে না। বিশ্ববিধাতার ইচ্ছানুযায়ী এরূপ ঘটনা সংঘটিত হয়। অদৃষ্টবাদের বিশ্বাস একেবারে নেতিবাচকও হতে পরে। এমন ক্ষেত্রে মানুষ মনে করে যে, বিশ্বের ঘটনা প্রবাহের মধ্যে মানুষ একেবারে অসহায়। আবার এ বিশ্বাস যুক্তিগত হতে পারে।

যুক্তিগত বিশ্বাসে মানুষ এরূপ যুক্তি দেবার চেষ্টা করে যে, স্রষ্টার দ্বারা যখন সৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টার হাতে বিশ্বের সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তিগত অদৃষ্টবাদ কোনো কোনো ব্যাখ্যায় ‘নির্ধারিত ভবিষ্যৎ’-এর তত্ত্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে। আবার কেউ একে ‘ইচ্ছাবাদ’ বলেও অভিহিত করেছেন। ‘ইচ্ছাবাদের’ দাবি হলো যে, বিশ্বের মূল হচ্ছে ইচ্ছা। ইচ্ছার কারণেই বিশ্বের সৃষ্টি। বিশ্বের ঘটনা-প্রবাহ কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, এক অলৌকিক ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত। মানুষের ইচ্ছা পরিবেশের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের ইচ্ছারও মূল হচ্ছে সেই অতিপ্রাকৃতিক আদি ইচ্ছা। এখানে অবশ্য আদি ইচ্ছা বলতে প্রকারান্তরে বিধাতাকেই বুঝান হয়।

ইতিহাসে অদৃষ্টবাদ সব সময়েই জ্ঞান এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা গ্রহণ করেছে। একদিকে অদৃষ্টবাদ মানুষকে ঘটনা-প্রবাহের নিষ্ক্রিয় দাসে যেমন পরিণত করতে পারে, তেমনি অদৃষ্টবাদের মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং অন্ধ জাতীয়তা ও ফ্যাসিবাদ সমাজকে গ্রাস করতে পারে। ভাগ্য আমাদের বিশ্ব-শাসনের জন্য নির্বাচিত করেছে, আমরা নির্বাচিত জাতি –এ বিশ্বাসেই ফ্যাসিবাদের জন্ম।

আরো পড়ুন:  ইতিহাসের দর্শন হচ্ছে মানুষের আর্থনীতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিকাশের অন্তর্নিহিত আলোচনা

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৬৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!