বিবর্তন ও বিপ্লব এর মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক প্রসঙ্গে

বিবর্তন (ইংরেজি: Evolution) বলতে কোনো অস্তিত্ব বা বিষয়ের মধ্যে পরিবর্তনের ধারাবাহিক এবং পরিমাণগত বৃদ্ধিকে বুঝায়। বিপ্লব বলতে বিকাশের কোনো পর্যায়ে অস্তিত্বের মধ্যে দ্রুত এবং আকস্মিক পরিবর্তন বুঝায়। বিবর্তন ও বিপ্লব বিকাশের অবিচ্ছেদ্য দুটি দিক।

বিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যকার সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য, এটি আধুনিক বিজ্ঞানের এবং সমাজবিজ্ঞান, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্ব। পূর্বে মানুষ বিবর্তন ও বিপ্লবকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং বিরোধাত্মক ব্যাপার বলে মনে করত। পূর্বে এরূপ ধারণা ছিল যে, বিবর্তন ঘটতে থাকবে; অর্থাৎ পরিবর্তনের কেবল পরিমাণগত বৃদ্ধি হতে থাকবে, অস্তিত্বে নতুন কোনো গুণের উদ্ভব হবে না। এ ধারনার অস্তিত্বের বিকাশে বিবর্তন একমাত্র প্রক্রিয়া। এ ধারণায় বিপ্লব কেবল জবরদস্তির নামান্তর। অস্তিত্বের বহির্ভূত কোনো শক্তি হিসাবে বাইরে থেকে অস্তিত্বকে পরিবর্তিত করতে চায়।

আধুনিক বিজ্ঞান অস্তিত্বের বিকাশের ধারণাকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। পানি যখন উত্তপ্ত হতে থাকে, তখন পানির মদ্যে বিন্দু বিন্দু পরিমান পরিবর্তন সংঘটিত হতে থাকে। কিন্তু পরিবর্তনের এই বৃদ্ধি অনির্দিষ্ট কালের জন্য কেবল পরিমাণেই সীমাবদ্ধ থেকে পানিকে পানি হিসাবে বজায় রেখে এগোয় না। পরিবর্তনের পরিমাণগত বৃদ্ধির একটা চরম বিন্দুতে পানির পুরাতন অস্তিত্বের আমূল রূপান্তর সংঘটিত হয়। পানি বাষ্পে পরিণত হয়। পানি থেকেই বাষ্প; কিন্তু পানি এবং বাষ্পকে আমরা দৃশ্যত এক অস্তিত্ব মনে করি না। এখানে পানির বিকাশে বিবর্তনের একটা স্তরে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, এ কথা বলা যায়। প্রাকৃতিক জগতে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

সামাজিক জীবনে বিবর্তন ও বিপ্লব প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ ঘটেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং মার্কসবাদের হাতে। মার্কসবাদের প্রবক্তাগণ প্রাকৃতিক জগতের অস্তিত্বে সক্রিয় পরিবর্তনের নিয়মকে সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বলেন যে, সমাজ-দেহেও পরিবর্তনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে একটি চরম পর্যায়ে বিপ্লব সংগঠিত হয়। বিপ্লব কোনো অস্বাভাবিক কিংবা অস্তিত্বের বহির্ভূত ব্যাপার নয়। বস্তুগত কিংবা সামাজিক সমস্ত অস্তিত্বই সতত গতিশীল। অস্তিত্ব মাত্রের গতি সৃষ্টি হয় তার আভ্যন্তরিক বিরোধের ভিত্তিতে। অস্তিত্বের অন্তর্গত দ্বন্দ্বমান শক্তির বিরোধ বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধি পেতে পেতে একটা বিস্ফোরণের মূহুর্তে উপস্থিত হয়। এক বিস্ফোরণই বিপ্লব। বিপ্লবের ফলে অস্তিত্বের এমন সব চরিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে চরিত্রগুলি বিপ্লবের পূর্বে অস্তিত্বের মধ্যে সুপ্ত কিংবা স্বল্প প্রকাশিত ছিল; কিন্ত এরূপ প্রবল এবং প্রধান হয়ে কার্যকর হয় নি।

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্টগণ

বিবর্তন শব্দের একটা সাধারণ ব্যবহার আছে। সমাজের বিবর্তন, বিশ্ব জগতের বিবর্তন। এরূফ ব্যবহারে কোনো ক্ষেত্রে বিবর্তন ও বিপ্লবসহ পরিবর্তনের সমগ্র বিষয়টিকেই বুঝান হয়।

বিপ্লব শব্দের অনেক বিকৃত এবং সংকীর্ণ ব্যবহারও দেখা যায়। বিপ্লবের মৌলিক অর্থ অস্তিত্বে অদৃষ্টপূর্ব নতুন চরিত্রের উদ্ভব। কিন্তু অনেক সময়ে কোনো রাষ্ট্রকাঠামোতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জবরদস্তি ক্ষমতা দখলকেও বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে শাসনযন্ত্রের অধিকারীর ক্ষেত্রে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কিছু সংখ্যক ব্যক্তির রদ-বদল সংঘটিত হয়েছিল। এই ঘটনায় পাকিস্তানের সামাজিক চরিত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি। কিন্তু শাসকগণ একে বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছিল। জবরদস্তি এবং রক্তপাত মাত্রকেই বিপ্লব বলা যায় না। বাস্তব সমাজের মধ্যে মৌলিকভাবে নতুন চরিত্রের উদ্ভব বিপ্লবকে সূচিত করে।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৬১-১৬২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!