ভালো ও মন্দ হচ্ছে মানুষের সামাজিক লক্ষ্য সাধনের উপায়ের নীতিবাদ সূত্র

ভালো ও মন্দ (ইংরেজি: Good and evil) হচ্ছে মানুষের সামাজিক আচরণের লক্ষ্য এবং লক্ষ্য সাধনের উপায়ের মূল্যায়নসূচক নীতিবাদ সূত্র। একটা বিশেষ সমাজে যে আচরণকে বাঞ্ছিত ও অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় তাকে ভালো এবং যা অবাঞ্ছিত ও পরিত্যজ্য তাকে মন্দ বলে চিহ্নিত এবং অভিহিত করা হয়।

ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় –এই নীতিবাদী সূত্র কাল ও সমাজ নিরপেক্ষ সূত্র নয়। আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে এর প্রথম উদ্ভব। ব্যক্তির সমন্বয়ে গোত্র কিংবা সমাজ- কিন্তু গোত্র সমাজভুক্ত ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী আচরণ করতে থাকে তা হলে আর গোত্র বা সমাজ সংবদ্ধ থাকতে পারে না। তখন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আচরণের বিরোধ ও সংঘর্ষে সমাজ ভেঙে যায়। কিন্তু সমাজ বাদে ব্যক্তির জীবন ধারণ সম্ভব নয়। মানুষের এই মৌলিক অভিজ্ঞতা থেকেই ব্যক্তির আচরণের সামাজিক মূল্যায়ন এবং সমাজের সংগঠন ও শৃঙ্খলার সহায়ক আচরণ বাঞ্ছিত ও কাম্য বা ভালো এবং সমাজের অহিতকর আচরণ মন্দ বলে অভিহিত হতে শুরু করে।

সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশে ক্রমান্বয়ে যখন রাষ্ট্রীয় সংগঠন উদ্ভুত হয় তখন ‘ভালো’, ‘মন্দ’, ‘ন্যায়’, ‘অন্যায়’ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় বিধান হিসাবে করণীয়, অকরণীয়, শাস্তিযোগ্য, পুরস্কারযোগ্যরূপে লিপিবদ্ধ হতে থাকে। এই পর্যায় থেকে সামাজিক ভালো-মন্দ বোধগুলি শ্রেণি চরিত্রও লাভ করতে শুরু করে। সমাজের ভালো-মন্দ এখন থেকে শাসক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য আইন বিধিবদ্ধ হতে থাকে।

ভালো মন্দের দার্শনিক আলোচনায় দুটি প্রধান ধারা লক্ষনীয়। এর একটি হচ্ছে ভাববাদী ধারা। ইমানুয়েল কাণ্টের রচনায় এর প্রকৃষ্ট প্রকাশ দেখা যায়। এই মত অনুযায়ী ভালো ও মন্দ হচ্ছে সমাজ এবং কাল নিরপেক্ষ এক অলৌকিক আদর্শ দ্বারা নির্দিষ্ট। মানুষের মধ্যে ভালোত্বর যে বোধ আছে এটা তার সহজাত ধারণা। তার এ ধারণা হচ্ছে চরম অলৌকিক ভালোর প্রকাশ। মানুষের এই ভালোত্ববোধের জন্ম কোনো বাস্তব অবস্থার উপর নির্ভর করে না।

আরো পড়ুন:  স্বায়ত্বশাসন কাকে বলে?

বস্তুবাদী ধারণা কান্টের এই ধারনার বিপরীত। বস্তুবাদ, বিশেষত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে ভালোমন্দ বোধ মানুষের জীবন যাপনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনবোধ থেকেই সৃষ্ট হয়েছে। যে আচরণ জীবনের সহায়ক তাই ভালো। যা জীবনের জন্য ক্ষতিকর তাই মন্দ। এই ভালো-মন্দর ধারণা যুগ এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সুতরাং চরম ভালো বলে কোনো অলৌকিক আদর্শ নেই।

বস্তুবাদী ও ভাববাদী এই দুই ধারার মধ্যে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দার্শনিক ভালো-মন্দর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।। প্রাচীন গ্রিসের এরিসটিপাস এবং এপিকিউরাস বলতেন, যে আচরণ মানুষের জন্য সুখ আনয়ন করে সেই আচরণ বা বস্তু ভালো এবং যা মানুষের দুঃখের কারণ তা মন্দ। এজন্য তাঁদের নীতিবাদকে সুখবাদ বলে অভিহিত করা হয়।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৮৩-১৮৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!