ন্যায়বিচার হচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবনের কার্য্ক্রম, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধ

ন্যায়বিচার বা ন্যায় (ইংরেজি: Justice) হচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবনের কার্য্ক্রম, আচার আচরণের মূল্যবোধক শব্দ। কিন্তু মানুষের কোন্ কাজ ন্যায় এবং কোন্ কাজ অন্যায় এ নিয়ে দর্শন ও নীতিশাস্ত্রে বিভিন্ন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যক্তির কোনো বিশেষ কাজ বা আচরণকে ন্যায় বলে এবং অপর কোনো কাজকে অন্যায় বলে নির্দিষ্ট করে। কিন্তু এই ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি কি?

পূর্বে এরূপ ধারণা করা হতো যে ন্যায় অন্যায়ের একটা চরম এবং স্থায়ী অতিলৌকিক মাপকাঠি আছে। সেই মাপকাঠির আদর্শ কেবলমাত্র ব্যক্তির নয়, সামাজিক সমস্ত সংস্থার আচরণও মূল্যায়িত হয়। ন্যায়-অন্যায়ের সেই চরম মাপকাঠি মানুষের জন্য কেবল তার সমাজ জীবনের নিয়ন্ত্রণকারী নয়, সে আদর্শ তার জীবনে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণাদায়ক, আকর্ষণ এবং কাম্য শক্তি হিসাবেও কাজ করে। কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ের সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাস ও পর্যালোচনা প্রমাণ করেছে যে মানুষের ন্যায়-অন্যায়বোধ কোনো অপরিবর্তনীয় স্থায়ী ধারণা নয়।

ন্যায়-অন্যায়ের কোনো চরম অতিলৌকিক বা ভাবগত মানদন্ডের অস্তিত্ব নেই। মানুষের ন্যায়-অন্যায়বোধ যে কেবল সমাজ থেকে সমাজে এবং যুগ থেকে যুগে পৃথক ও পরস্পরবিরোধী হয়েছে তাই নয়। দ্বন্দ্বমান শ্রেণীতে বিভক্ত কোনো সমাজের মধ্যে একইকালে একই বিষয়ে ন্যায়-অন্যায়ের পরস্পরবিরোধী পরিমাপক অনুসৃত হতে পারে।

শ্রমিকের শ্রম ক্রয় করা এবং এই শ্রমের ভিত্তিতে মুনাফা অর্জন করা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে যেখানে পুঁজির মালিক শ্রেণী ন্যায্য, আইনসঙ্গত এমনকি সর্বজন মান্য বলে বিবেচনা করে, সেখানে শ্রমের মালিক অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী তাকে অন্যায় ও অসঙ্গত বলে বিবেচনা করে। ন্যায়-অন্যায়ের একমাত্র বৃহৎ এবং স্থায়ী মাপকাঠি হতে পারে মানুষের কল্যাণ ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের। কিন্তু পরস্পর সংঘাতমূলক শ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত কোনো রাষ্ট্রে ন্যায়-অন্যায়ের এরূপ একক মাপকাঠির চিন্তা করা যায় না। দ্বন্ধমান শ্রেণীর যেখানে বিলোপ ঘটেছে সেরূপ সমন্বিত সমাজেই মাত্র ন্যায়-অন্যায়ের একক মাপকাঠির উদ্ভব ঘটতে পারে।

প্লেটো এবং এরিস্টটলের রাষ্ট্রনীতির দর্শনে ‘ন্যায়বিচার’ এর বিশেষ আলোচনা দেখা যায়। গ্রিকগণ ন্যায়কে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অলঙ্ঘনীয় আদর্শ বলে বিবেচনা করতেন। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে দর্শনগুরু সক্রেটিস এবং সঙ্গীদের বিতর্কে ন্যায়কে অন্যতম আলোচনার বিষয় হিসাবে উপস্থিত করেন। ন্যায় সম্পর্কে প্লেটোর অভিমতের তাৎপর্য্য হচ্ছে : সমাজে যার যেমন অবস্থান সেই অবস্থান অনুযায়ী ব্যক্তির করণীয় করাই হচ্ছে ন্যায়। আবার সেই অবস্থান অনুসারে সমাজের কাছ থেকে যার যা প্রাপ্য তা পরিশোধ করাই হচ্ছে সমাজের পক্ষে ন্যায়। মোট কথা যে দাস সে দাসের মত থাকবে এবং যে প্রভু সে প্রভুর ন্যায় দাসকে শাসন করবে। এরূপ তত্ত্বের মূল অর্থ হচ্ছে প্রচলিত ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন কাম্য নয়।

আরো পড়ুন:  গণতন্ত্র ও নীতিবিদ্যার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৪৮-২৪৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!