সার্বিক হচ্ছে বস্তু জগৎকে জানার জন্য মানুষের তৈরি একটি দার্শনিক সূত্র

সার্বিক বা সামান্য (ইংরেজি: Universal) এবং বিশেষ হচ্ছে জ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বস্তু জগৎকে জানার জন্য মানুষের তৈরি একটি দার্শনিক সূত্র। বস্তুর সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর সম্পর্কের বিভিন্নতাকে এই সূত্রগুলির সাহায্যে মানুষ প্রকাশ করে। বস্তুজগতে বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক সাদৃশ্য ও পার্থক্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়। একটি ব্যক্তি বা বস্তু অপর ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে তুলনায় যে কারণে পৃথক বলে চিহ্নিত হয় সে কারণ বা গুণকে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বলা হয়। এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুকে আমরা বিশিষ্ট বা বিশেষ বলি।

বস্তুর সঙ্গে বস্তুর পার্থক্য যেমন বস্তুকে বিশিষ্ট করে, তেমনি বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সাদৃশ্য বস্তুর কোনো গুণকে সার্বিক বলে চিহ্নিত করে। ‘রাম, রহিম, বা লাল রঙের কুকুরটি’ পদগুলি বিশিষ্ট পদ। আবার রাম, রহিম, করিম প্রভৃতি ব্যক্তির মধ্যে সাদৃশ্য হচ্ছে এই যে, তারা সকলেই মানুষ। সুতরাং তাদের মানুষ হওয়ার গুণটি বা মনুষ্যত্ব সার্বিক বা সাধারণ। যুক্তিবিদ্যায় সার্বিক বা সাধারণ পদ দ্বারা সে সমস্ত গুণকেই বুঝায় যে গুণ কোনো একটি জাতির অন্তর্গত কোনো সকল ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যেই বিরাজিত। মানুষ বা মনুষ্যত্ব সার্বিক বা সাধারণ। কারণ মানুষ জাতির অন্তর্গত সকল ব্যক্তির এই গুণ রয়েছে। ‘একটি লাল কুকুর’ বিশেষ বা বিশিষ্ট পদ। কিন্তু ‘কুকুর’ পদটি সার্বিক বা সাধারণ। কারণ কুকুর বলতে কুকুর প্রজাতির সকল জীবকে বুঝায়।

বিশিষ্ট, বিশেষ এবং সার্বিক পদগুলি পরস্পর সম্পর্কিত। তথাপি সার্বিক বা সার্বিকতা বলতে কি বুঝায়, এটি দর্শনের একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। ইতিহাসগতভাবে বলা যায় যে, মানুষের মধ্যে সার্বিকতার বোধ প্রথমে উদ্ভব হয় বস্তুর সঙ্গে বস্তুর গুণের সাদৃশ্য এবং কোনো গুণের পৌনঃপুনিক অস্তিত্বের প্রকাশ থেকে। কালক্রমে একটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়। বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সাদৃশ্য যে গুণের ক্ষেত্রে দেখা যায় সে গুণের মূল কি? গুণটির কি নিজস্ব কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে না এটি মানুষের মনের কল্পনা বা বিভিন্ন বস্তুর বিশেষ গুণের মানসিক বিশ্লেষণ? দৃষ্টান্তসরূপ ‘মানুষ’ একটি সার্বিক পদ অর্থাৎ যাদের মানুষ হওয়ার গুণ আছে তারা সকলেই মানুষ। তা হলে মানুষ হওয়ার গুণ বা ‘মনুষ্যত্ব’ কি বিশেষ মানুষের বাইরের কোনো অস্তিত্ব? না ‘মনুষ্যত্ব’টা মানুষের মনের একটি কল্পনা যার সঙ্গে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে কোনো জীবকে মানুষ বলা হয়।

আরো পড়ুন:  বিশেষ হচ্ছে বস্তু জগৎকে জানার জন্য মানুষের তৈরি একটি দার্শনিক সূত্র

আদি গ্রীক দার্শনিকগণ ‘সার্বিক’ গুণকে এক প্রকার বিশেষ অস্তিত্বময় বস্তু বলে বিবেচনা করতেন। থেলিস এর কাছে ‘পানি’ ছিল সার্বিক। কারণ তিনি মনে করতেন আর সব বস্তুর মধ্যে পানি আছে; পানির দ্বারা আর সব বস্তু তৈরি। হেরাক্লিটাস মনে করতেন, ‘আগুন’ হচ্ছে সার্বিক বস্তু। ডিমোক্রিটাস মনে করতেন ‘অণু’ হচ্ছে সার্বিক বস্তু বা সকল সৃষ্টির মূল।

কিন্তু প্লেটো তাঁর কূট যুক্তি দিয়ে বললেন, সার্বিক কোনো বিশেষ বস্তু হতে পারে না। সবার মধ্যে আছে বলে সার্বিক। কিন্তু সে নিজে বস্তু হিসাবে থাকলে বিশেষ হয়ে যায়। তাই সার্বিক এর স্বাধীন অস্তিত্ব যেমন আছে তেমনি সে আবার বস্তু নয়। সার্বিক হচ্ছে স্বাধীন অস্তিত্বময় ভাব। এরিস্টটল প্লেটোর মতকে পুরো স্বীকার করেন নি। তিনি সার্বিক গুণকে একদিকে বিভিন্ন বস্তুর বিশ্লেষণে মনের আহ্নত গুণ বলে উল্লেখ করেছেন, আবার অপর দিকে এ গুণকে কেবল মনের নির্ভরশীল বা মনের কল্পনাতে পর্যবসিত করেন নি। সপ্তদশ শতকে ইংরেজ দার্শনিক লক সার্বিকতাকে মানুষের মনের বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রকাশ বলে আখ্যায়িত করে সার্বিক গুণের স্বাধীন অস্তিত্বকে একেবারেই অস্বীকার করেন।

বিশেষ ও সার্বিকের সম্পর্কটি দ্বন্দ্বমূলকভাবে বুঝা সঙ্গত। বস্তু-জগতের সামগ্রিকতা হচ্ছে ‘সার্বিক’। এই সমগ্র বা সার্বিকতার মধ্যে বিশেষ বস্তু একটির সঙ্গে আর একটি সম্পর্কিত। সম্পর্কের অনিবার্য দুটি দিক হচ্ছে তার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য, বিশিষ্টতা এবং সর্বজনীনতা। মানুষ বস্তুজগতের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বস্তুর এই পারস্পরিক ও সামগ্রিকতাকে যত বুঝতে সক্ষম হয়েছে তত সে তার মধ্যে বিশেষ ও সার্বিককে মানসিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২২০-২২২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!