কোনও কাজ করার স্বাধীনতা থাকা বা না-থাকার সূত্রে অধিকার শব্দটি উদ্ভূত। শব্দটির মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণীত হয়। বস্তুত অধিকার রাষ্ট্রে সদর্থক উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে। অধিকারের প্রদানের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধিত হয়। ব্যক্তিমানুষের কল্যাণের অস্তিত্বে প্রমাণিত হয় যে রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। সমাজের অঙ্গ রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে অধিকার সৃষ্টি ও রক্ষা করে। লাস্কির মতে, অধিকার হলো সমাজজীবনের এমন কিছু শর্ত যেগুলি না থাকলে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীন বিকাশ ব্যাহত হয়। অধিকারসমূহের কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে আইনের মাধ্যমে স্বীকৃতির উপর। প্রতিটি অধিকারের একটি সামাজিক মূল্য এবং উদ্দেশ্য থাকে। সামাজিক কল্যাণের কিছু-না-কিছু শর্তপূরণ ও সমাজের অল্পবিস্তর উন্নতি সাধনে কী ভূমিকা পালন করে তার উপর নির্ভর করে ভিন্ন অধিকারের যথার্থ বৈধতা (হবহাউস)। সমাজের প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পক্ষে অধিকারকে যেন অনুকূল হয়।
অধিকারের নানা প্রকারভেদ আছে। সেগুলিকে মােটামুটি নৈতিক ও আইনানুগ এই দুই বর্গে ভাগ করা যেতে পারে। নৈতিক অধিকারগুলির মধ্যে পড়ে নীতিবােধ, বিবেক, বিচারশক্তি ইত্যাদি মূল্যবােধ। এগুলি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযােগ্য নয়। আদর্শগত তত্ত্বে অবশ্য এগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। এ ছাড়াও আছে প্রাকৃত অধিকার (natural rights), সে প্রসঙ্গ পরে আসছে।
আইনানুগ অধিকারগুলি তিন ধরনের : পৌর (civil), রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক। পৌরজীবনে লােকের এমন কিছু সুবিধা বা অধিকার থাকা চাই যেগুলি ছাড়া মানুষের বিকাশ ও ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটে না। যেমন বাক-স্বাধীনতা, লেখার কিংবা সংস্থা গঠনের, জীবন-ধারণ, ঘােরাফেরা, পরিবার-জীবন, ধর্মাচরণ, শিক্ষার্জনের অধিকার ইত্যাদি (civil rights)।
রাজনৈতিক অধিকার বলতে রাষ্ট্রীয় কার্যনিবাহে অংশগ্রহণ বােঝায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজনৈতিক ক্ষমতার তত্ত্ব আর অধিকারের সমার্থক নয়। ক্ষমতার উৎসে যাবার সুযােগ থাকাটা একটা রাজনৈতিক অধিকার। ভােট দেবার, নির্বাচনে প্রার্থী হবার, দল গঠনের, মতামত প্রকাশ করার, স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ প্রতিরােধের, সরকারি চাকরি পাবার, সরকারের বিরুদ্ধে অভিযােগ থাকলে তার সুরাহার জন্য আবেদন করার অধিকারই ইত্যাদি রাজনৈতিক গােত্রের। এই সূত্রে কিছু অর্থনৈতিক অধিকারের কথা এসে পড়ে, যেগুলির আইনানুগ রূপায়ণের নিশ্চয়তা সব সময় থাকে না; যেমন চাকরি বা জীবিকানিবাহের অধিকার। সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত মালিকানায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার, সম্পত্তি ভােগ করার অধিকার, শ্রমিকদের কাজের সময়, ন্যায়সংগত মজুরি ইত্যাদি বিষয় আর্থনীতিক অধিকারের আওতায় পড়ে।
ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের নানা ধরনের পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) হিসেবে লিপিবদ্ধ এবং তৎসহ সম্পত্তির অধিকারও সংরক্ষিত হয়েছে। অবশ্য জনস্বার্থে কোনও সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হলে ক্ষতিপূরণের বিধানও আছে।
প্রাকৃত-অধিকারের সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ও চুক্তিতত্ত্বের প্রবক্তাদের অভিমত হলো যে মানুষের কতকগুলি জন্মগত অধিকারই থাকে; সেসব অধিকারকে সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠের আগে মানুষ ভােগ করত। প্রকৃতির রাজত্বে মানুষের ছিল নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। সমাজ গড়ে ওঠার পরে সেগুলি লুপ্ত হয়ে যায়নি। জীবন-ধারণ, সম্পত্তি ভােগ এবং অবাধ বিচরণের অধিকার প্রাক-সমাজ পর্বে বিরাজমান ছিল। অধিকারগুলি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকে না। রাষ্ট্র তথা সমাজ সৃষ্টির পূর্বে এইসব প্রাকৃত অধিকারে বিরাজ করত এবং সেগুলি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। হবস, লক, রুসাে এই ধরনের চিন্তা করেছেন।
কার্যত মানুষের যাবতীয় অধিকার সমাজ ও রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর সৃষ্ট হয়। বেনথাম এরকম মত দিয়েছেন যে, অধিকারের তখনই মূল্য দেখা দেয় যখন নিজের ক্ষমতায় রাষ্ট্র তাকে সংরক্ষণ ও রূপায়ণ করে। কাজেই অধিকার হলো রাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। প্রাকৃত অধিকারের উৎপত্তি ও যথার্থ প্রকৃতি সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ আছে।
মার্কসীয় অধিকারের তত্ত্বের উৎস হলো মার্কসীয় অর্থনীতি ও দর্শন। শ্রেণীগত স্বার্থের আর্থনীতিক ভিত্তির উপর স্থাপিত উপরিকাঠামাে সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ প্রতিফলিত করে; অধিকার তত্ত্ব রাজনীতির অন্তর্গত; রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি সবই আর্থনীতিক ভিত্তি অনুযায়ী উপরিকাঠামােয় প্রতিফলিত হয়। শ্রেণীগত স্বার্থ দ্বারা চালিত রাজনৈতিক কর্তৃত্বের যারা অধিকারী তাদের নির্দেশে আইন তৈরি হয়। মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তবাদ অনুযায়ী শ্রেণী সংগ্রাম ও বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক তথা সর্বহারা শ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী। স্বভাবতই সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পর তাদের অভাব ও চাহিদা অনুযায়ী অধিকার সংক্রান্ত আইন বিধিবদ্ধ হবে।
চিত্রের ইতিহাস: পারস্য সাম্রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের নির্দেশ সম্বলিত সাইরাস সিলিন্ডার, যা দুই হাজার ৬০০ বছরের পুরোনো। আলোকচিত্র: Mike Peel.
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৩-১৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।