ঘোল বা মাঠা ছাছ বা ছচ্ছিকা (ইংরেজি: Whey) বাংলার একটি পরিচিত শব্দ। মানুষ গরম থেকে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এই পানীয় খেয়ে থাকে। দই এর কথা এলেই ঘোলের কথা মনে আসে। দুধ হতে ছানা অপসারণ করার পরে যে অবশিষ্ট থাকে তাকে ঘোল বলা হয়। এটি শরীরে নানা রোগ প্রতিরোধের জন্য উপকারি। দুধ পান করতে যাদের সমস্যা হয় তারা ঘোল পান করলে দুধের অন্যান্য প্রয়োজনিয় উপাদান পাওয়া যাবে।
ঘোল: আমরা বাঙালিরা সাধারণত দইয়ে চিনি ও অল্প জল মিশিয়ে কাঁটা দিয়ে বা মিক্রারে ঘুটে ঘোল তৈরি করি। জল না মিশিয়ে বা অল্প জল মিশিয়ে দইয়ের সর বা মাখন তুলে না নিয়ে মন্থন করলে ঘোল তৈরি হয়। ঘোল খেলে যে শরীর ও পেট ঠাণ্ডা হয় এ কথা সকলেই জানেন। মিশ্রি মেশানো ঘোল খুব উপকারী। ঘোল ত্রিদোষ অথাৎ কফ, বাত, পিত্ত নাশ করে। অনেক অসুখেই ঘোল পথ্য হিসেবে খেতে দেওয়া হয়। তবে মুর্চ্ছা ও রক্তপিত্ত রোগে ঘোল ভাল নয়। এই রকম অভিমত আছে।
ছাছ বানাবেন কীভাবে: দইয়ের গুণের কথা তো সকলেরই জানা কিন্তু দইয়ের পাতলা ঘোল যাকে অবাঙালিরা ছাছ বলেন সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় ছচ্ছিকা তার যে কত গুণ সে কথা সকলের জানা নেই। ছাছ হলো ঘোলের চেয়েও হালকা। উত্তর প্রদেশে এই পানীয় খুবই জনপ্রিয়। প্রথমে জল মিশিয়ে দই ফেটিয়ে নিতে হয়। তারপরে দইয়ের ওপরের মাখন তুলে নিয়ে আবার জল মিশিয়ে ঘুটে নিলেই তৈরি হলো ছাছ। ঘোলের চেয়ে অনেক হালকা ও সুপাচ্য।
বাজারের মিষ্টি দই দিয়ে কিন্তু ছাছ তৈরি করা যাবে না চাই টাটকা টক দই তা ঘরে পাতাই হোক বা বাজারের কেনা। বাড়িতে অনায়াসেই এই পুষ্টিকর পানীয় তৈরি করে নেওয়া যায়। বিশেষত যাঁদের দুধ সহ্য হয় না তাঁরা এই পাতলা ঘোল খেলে উপকার পাবেন। ছাছ তৈরি করবার অসুবিধে থাকলে দইয়ের পাতলা ঘোল তৈরি করে খেলেও সমান উপকার পাবেন।
ছচ্ছিকার বা পাতলা ঘোলের অনেক গুণ:
আয়ুর্বেদ মতে, ছাছ বা পাতলা ঘোল মধুর রস, পিত্তকে শান্ত করে পোষণ করে টকভাব ও বায়ু দূর করে শরীরে বল দেয়, কফ দোষ দূর করে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে। টাটকা ছাছ বা পাতলা ঘোলকে আহারের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়।
চরক বলেছেন, খিদে না পাওয়া আর পেটের অসুখে ছাছ অমৃতের মতো।
সুশ্রুত বলেছেন, ছাই মধুর, টক, কষায়, উষ্ণবীর্য, লঘু, রুক্ষ, অগ্নিদীপক বা খিদে বাড়িয়ে দেয়, বিপাকে মধুর, হৃদ্য । ছাছের আছে বিষদোষ, ফোলা, পেটের অসুখ, একটানা পুরোনো পেটের অসুখ, জন্ডিস, অর্শ, প্লীহা রোগ, গুল্ম সারাবার গুণ। এছাড়াও মলরোধক, ম্যালেরিয়া বা পুরান জ্বর, পিপাসা, বমি, মুখ থেকে লালা পড়া, শাল, মেদবৃদ্ধি, কফ ও বায়ুরোগ উপশম করে।
বৈজ্ঞানিক মতে, ছাছে আছে ভিটামিন সি। অতএব নিয়মিত ছাছ পান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেড়ে যায়। ত্বকের অসুখ সারে আর শারীরিক সৌন্দর্য অক্ষুন্ন থাকে। ছাছ-এ ল্যাকটিক অ্যাসিড থাকায় হজম সংক্রান্ত সব অসুখে উপকার দেয়। ছাছে প্রোটিন এবং আরও অনেক তত্ত্ব থাকবার জন্যে অপুষ্টির সব রকম অসুখ সারিয়ে দেয়।
গরমকালে যখন তেষ্টা বেশি পায় তখন ছাছ শরবত হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। ছাছে যে টকভাব আছে তার সাহায্যে খিদে পায়, খাওয়া-দাওয়ায় কুচি আসে আর খাবার হজমও হয় তাড়াতাড়ি। যাঁদের টক ঢেকুর ওঠে এবং গ্যাসে পেট ফুলে গেলে চিত্তচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায় ছাছ তো তাঁদের পক্ষে অমৃতের সমান । ছাছ খেলে মলশুদ্ধি হয়ে যায় পেট ফুলে ওঠার অস্বস্তি দূর হয়, শরীরে স্মৃতিভাব আসে, মনে উৎসাহ জাগে পেটের এবং অস্ত্রের ক্রিয়ার মধ্যেও একটা সহজভাব আসে। পাচনতন্ত্রের কাজ ভালো হয়, সেইজন্যে খিদেও বেড়ে যায়।
ছাছ বায়ু দূর করে। অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণা আছে যে ছাছ ঠাণ্ডা। কিন্তু ছাছ আসলে উষ্ণবীর্য অথাৎ শরীরের গরম প্রভাব উৎপন্ন করে। মল জমে থাকার জন্যে শরীরে যে বায়ুবিকার হয় ছাছ খেলে তা দূর হয়ে যায়।
ছাছ খেলে হার্টের উপকার হয়, রক্ত শুদ্ধ হয়, পেটের অসুখে বিশেষ করে বেশি উপকার পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে মলত্যাগ সম্পর্কিত সব কিছুই ঠিক মতো ব্যবস্থিত হয় অর্থাৎ মলরোধ করে কোষ্ঠকাঠিন্যেরও সৃষ্টি করে না।
অন্ত্র সম্পর্কিত সব রোগে ছাছ খাওয়া ভাল। ছাছ অস্ত্রগুলো সঙ্কুচিত করে তাদের বেশি ক্রিয়াশীল করে তোলে এবং অন্ত্রে জমে থাকা পুরোনো বন্ধ মল বাইরে বের করে দেওয়ার জন্যে ধাক্কা দিতে থাকে। সেইজন্যে শরীরে পুরোনো মলদোষ জমে থাকার জন্যে টাইফয়েড রোগের উৎপত্তি সেই টাইফয়েডে রোগীকে ছাছ খেতে দেওয়া হয় পথ্য হিসেবে।
ছাছ শরীরের মেদ কমিয়ে দেয়, সেইজন্যে যাঁরা ডায়েটিং করছেন তাঁদের পক্ষে ছাছ আদর্শ । হার্টের দুর্বলতা ও ব্লাডপ্রেশার কমাতে ছাছের জুড়ি নেই বলাই চলে। এই সব অসুখেও ছাছ পথ্য হিসেবে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে যাঁরা নিয়মিত ছাছ পান করেন তাঁদের বার্ধক্য দেরিতে আসে। চামড়ায় বলি রেখা পড়ে না, এবং যদি বলি রেখা পড়েও গিয়ে থাকে নিয়মিত ছাই পান করলে তা দূর হয়ে যায়। এ ছাড়াও ছাছে আছে আমদোষ বা আমাশায় নাশ করবার মহৎ গুণ।
সুস্থ থাকতে খাওয়া-দাওয়ায় পাতলা ঘোলের প্রয়োগ:
১. শুকনা আদা বা শুঠ, গোলমরিচ, নুন আর পিপুল সমপরিমাণে নিয়ে চূর্ণ করে পাতলা ঘোলে মিশিয়ে খেলে অজীর্ণ রোগ বা খাবার হজম না হওবার অসুখ সারে। শুধু নুন গোলমরিচ মিশিয়ে খেলেও উপকার পাওয়া যায় ।
২. ছাছে চিত্রক বা রাংচিতার মূল চূর্ণ মিশিয়ে খেলে জন্ডিসে উপকার হয়।
৩. টাটকা ছাছে বেলের শাঁস মিশিয়ে খেলে রক্ত আমাশা আর পেটের অসুখে উপকার পাওয়া যায়।
৪. পাতলা দইয়ের ঘোলে হিং, জিরে ভাজা যা শুকনো খোলায় ভাজতে হবে, তার সাথে নুন মিশিয়ে খেলেও অর্শ ও পেটের অসুখ ও পেটের ব্যথা কমে।
৫. টাটকা পাতলা ঘােলে চিত্ৰক মূল (রাংচিতার মূল) গুঁড়াে করে মিশিয়ে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিদিন নিয়মিত পান করলে অর্শ সেরে যায়।
৬. ছাছ বা পাতলা ঘোলে বিট নুন আর যোয়ান মিশিয়ে খেলে বদ্ধকোষ্ঠ অথাৎ পেটের মধ্যে জমে থাকা বদ্ধ মল মুক্ত হয়।
৭. ছাছ বা পাতলা ঘোলে গুড় মিশিয়ে খেলে মূত্রকৃচ্ছতার বা প্রস্রাব কম হওয়ার কষ্ট কমে যায়।
এইভাবে দেখতে গেলে রোগ সারাতে বা সুস্থ থাকতে খাওয়া-দাওয়ায় ছাছের গুণের প্রায় তুলনা নেই। সেইজন্যে ভাবমিশ্র ঠিকই বলেছেন, যাঁরা ছাছ খান তাঁরা কোনদিন রোগের শিকার হন না। ছাছ খেয়ে যে রোগ সেরে যায় সে রোগ আর কখনো হয় না।
তথ্যসূত্রঃ
১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা, ৩৫-৩৭।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।