মানসিক অস্থিরতা ও মানসিক অবসাদের কারণ এবং অস্থিরতা ও অবসাদ দূরীকরণের উপায়

মানুষের মনে যখন কোনো দুশ্চিন্তা দেখা দেয় তখন মনের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়। কোনো খারাপ খবর শুনে, খেলার বা পরীক্ষার খারাপ ফলাফলে বা নিকটজনের কোনো দুঃসংবাদ পেলে মনের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। অস্থিরতা প্রকট হলে শরীর ও মন দুইই ভেঙ্গে পড়ে। শরীর ও মন একে অপরের পরিপূরক। মানসিক অশান্তি থাকলে শরীর খারাপ হয়। মানসিক অস্থিরতা আমাদের জীবনে অনেক ব্যর্থতা ও দুর্গতির সৃষ্টি করতে পারে। মানসিক অসুস্থতার কারণে শিশুমনে মানসিক বিকৃতির সূচনা হয়। মাতা-পিতা বা অভিভাবক এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে শিশুমনের অস্থিরতা দূরীকরণে যত্নবান হবেন। 

প্রথমে মানসিক অস্থিরতার কারণ বের করতে হবে। পরে তার সাথে ভালো ব্যবহার করে, ধৈর্যশীল আচরণের মাধ্যমে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন, কেউ পরীক্ষায় ফেল করলে তাকে বকাবকি না করে তাকে বোঝাতে হবে, যে তুমি এখন থেকে ভালোভাবে লেখাপড়া কর তাহলে আগামীতে ভালো ফল করবে। মানসিক অস্থিরতা দূরীকরণ তথা প্রতিরোধের জন্য সুশিক্ষা, শিশুর স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন, পরিচর্যা, উন্নত পারিবারিক পরিবেশ, মাতা-পিতা ও অভিভাবকের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির প্রয়োজন। মানসিক আচরণের এই জটিল গতিপ্রকৃতি ও অস্থিরতা দূরীকরণে ধৈর্যশীল আচরণ, সুশিক্ষা, শিশুবান্ধব পরিবেশ, পুষ্টি ও আনন্দময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এর ফলে আগামীতে এক সুস্থ সবল জাতি গড়ে উঠবে যা সামগ্রিকভাবে দেশের এবং সকলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

মানসিক অবসাদ

একই কাজ অনেকক্ষণ ধরে করলে একঘেয়েমি আসে এবং সেই কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়। ফলে তার দেহে ও মনে পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তনের ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। মানসিক ও শারীরিক অবস্থার এই পরিবর্তনকেই ক্লান্তি বা মানসিক অবসাদ বলে। মূলকথা অবসাদ বলতে কর্মশক্তির শিথিলতা বা কর্মশক্তি হ্রাস পাওয়াকেই বোঝায়। কর্মক্ষমতা হ্রাসই হলো এর মূল কারণ। মনোবিজ্ঞানীদের মতে- ‘একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কোনো কাজের দরুন শরীরের কর্মক্ষমতার যে অবনতি হয় তাকে অবসাদ বলে।

অবসাদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (ক) দৈহিক অবসাদ (খ) মানসিক অবসাদ। 

আরো পড়ুন:  স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টি অনুসারে খাদ্য উপাদান হচ্ছে ছয় ধরনের খাদ্যের সমষ্টি

ক) দৈহিক অবসাদ: নির্দিষ্ট সময়ের বেশি ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করলে যে ক্লান্তি আসে তাকে দৈহিক অবসাদ বলে। এ অবসাদ দৈহিক পেশিঘটিত ও ইন্দ্রিয়গত। শ্রমের নির্দিষ্ট একটি সময় আছে সে সময় অতিক্রম করলে অবসাদ দেখা দেয়। ব্যায়াম বা পরিশ্রমের সময় যে শারীরিক চাহিদা অনুভূত হয় তা দেহ নিজেই পূরণ করে নেয়। যেমন- দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়ার ফলে অতিরিক্ত অক্সিজেনের চাহিদা মেটানো যায়। আবার রক্তের চাপ ও হৃদকম্পন বেড়ে গেলে শরীর থেকে অতিরিক্ত শর্করা নিঃসৃত হয়।

খ) মানসিক অবসাদ: অনেকক্ষণ ধরে মানসিক কাজ করতে থাকলে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অবসাদ দেখা দেয়। যেমন, বেশি সময় ধরে অংক করলে একটা পর্যায়ে অংক করার জন্য বিচার শক্তি, চিন্তা শক্তি ও নির্ভুলভাবে করার ক্ষমতা কমতে থাকে। এই কমতে থাকা বা পরিবর্তনের এই অবস্থাকে মানসিক অবসাদ বলে। তবে দৈহিক ও মানসিক কাজকে যেমন সম্পূর্ণ পৃথক করা যায় না, তেমনি দৈহিক অবসাদ ও মানসিক অবসাদকে আলাদা করা যায় না। অনেকক্ষণ দৈহিক পরিশ্রম করলে মানসিক অবসাদ আসতে পারে, তেমনি একটানা মানসিক কাজ করতে থাকলেও দৈহিক অবসাদ আসে।

শিক্ষার্থীর উপর মানসিক অবসাদের প্রভাব 

শিক্ষার্থী বলতে শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সকলকে বোঝানো হয়েছে। শারীরিক শিক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের যে দৈহিক অবসাদ আসে তা তাদের অবসাদের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। তাদের শারীরিক পরিশ্রমের ফলে বিপুল পরিমাণ ঘাম নি:সৃত হয়, শারীরিক অঙ্গ-সঞ্চালনের উপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু যখন তারা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে তখন যেসব প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায় তা নিম্নরূপ, 

১. তাদের কর্ম সম্পাদনে ভুল হতে থাকে।
২. তারা নিজেদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
৩. কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকে না।
৪. কাজের ছন্দ হারিয়ে ফেলে।
৫. অমনোযোগী হয়ে পড়ে, কলাকৌশল সঠিকভাবে আয়ত্ব করতে পারে না।
৬. কাজের একাগ্রতা কমে যায়।
৭. মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। 

মানসিক অবসাদের কারণ

দৈহিক, মানসিক, সামগ্রিক বা আংশিক যাই হোক না কেন তার পিছনে কতগুলো কারণ রয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি কর্মসূচিজনিত শারীরিক চাপের কারণে অবসাদ আসে। তবে আরও অনেক কারণে অবসাদ আসতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা অবসাদের কারণসমূহকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন- ১) দৈহিক, ২) মানসিক ও ৩) পরিবেশগত। দৈহিক অবসাদের জন্য মাংসপেশিতে ল্যাকটিক এসিডের সৃষ্টি হয় ফলে দেহকোষের ক্ষয়, শরীর থেকে লবণ বের হওয়া, অক্সিজেনের ঘাটতি ইত্যাদি অতিরিক্ত অঙ্গ সঞ্চালনের কারণে হয়ে থাকে। মানসিক অবসাদের কারণ হলো 

আরো পড়ুন:  খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণ এবং খাদ্যে বিষক্রিয়া রোধ করবার কয়েকটি সাধারণ সতর্কতা

১. মানসিক প্রস্তুতির অভাব: কোনো কাজ করার আগে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২. কাজে অভ্যস্ত না হয়ে ওঠা: কর্মসূচি নিয়মিতভাবে পালন না করলে ঐ কর্মসূচিতে অবসাদ আসে।
৩. কাজে প্রেষণা থাকতে হবে: কোনো কাজের পিছনে প্রেষণা থাকলে একটানা কাজ করেও অবসাদ আসে না। প্রেষণা থাকলে তাড়াতাড়ি অবসাদ চলে আসে।
৪. মানসিক ইচ্ছার অভাব: কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বা ইচ্ছা থাকতে হবে। ইচ্ছা না থাকলে দ্রুত অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
৫. পরিবেশগত কারণ: শারীরিক ও মানসিক কারণ ছাড়াও কিছু পরিবেশগত কারণেও অবসাদ আসতে পারে। খুব গরম, খুব ঠান্ডা বা গুমোট আবহাওয়া এগুলো কোনো কাজের পরিবেশ নয়। এ রকম পরিবেশে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। অনুরূপভাবে পরিমিত আলো, বাতাস ও পরিছন্ন পরিবেশ থাকলে অল্পতেই অবসাদ এসে ভর করতে পারে না। 

মানসিক অবসাদ দূরীকরণের উপায় 

দৈহিক ও মানসিক শক্তি ক্ষয়ের ফলেই অবসাদের সৃষ্টি হয়। তাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে দেহ ও মনের সুস্থতা ও সক্রিয়তা আনয়নের মাধ্যমে অবসাদ দূর করা সম্ভব। অবসাদ দূরীকরণের জন্য আমরা নিচের বিষয়গুলাের উপর গুরুত্বারােপ করতে পারি।

১. কর্মসূচির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি: যদি কর্মসূচির প্রতি আগ্রহ বাড়ানাে যায় তাহলে অবসাদ আসে না।
২. একঘেয়েমি পরিহার: কর্মসূচিতে যেন একঘেয়েমি না আসে সেদিকে লক্ষ্য রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। কর্মসূচিতে যেন আনন্দপূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজকর্ম থাকে।
৩. চাপযুক্ত কর্মসূচি পরিহার: শিক্ষার্থীরা যেন চাপ সহ্য করতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রেখে কর্মসূচি তৈরি করতে হবে।
৪. বিশ্রাম ও ঘুম: দেহের ক্ষয়পূরণের জন্য পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। তেমনি অবসাদ দূর করণের জন্য বিশ্রাম ও ঘুমের প্রয়োজন। বিশ্রাম ও ঘুমের ফলে দেহ ও মস্তিষ্কের অবসাদ দূর হয়।
৫. পরিবেশগত কারণ: অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, আলো-বাতাসের অভাব, এমন পরিবেশ পরিহার করে খোলা-মেলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্থানে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ করবে ও মানসিক অবসাদের কোনো প্রভাব পড়বে না।

আরো পড়ুন:  ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যরক্ষা হচ্ছে প্রত্যেকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মকানুন মেনে চলা

মনের মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা দেখা দিলে অস্থিরতা শুরু হয়। তখন শরীর ও মন দুইই ভেঙ্গে পড়ে। শরীর ও মন একে। অপরের পরিপূরক। মানসিক অশান্তি থাকলে শরীর খারাপ হয়ে পড়ে ফলে আমাদের জীবনে অনেক ব্যর্থতা ও দুর্গতির সৃষ্টি হয়। মানসিক অস্থিরতা দূরীকরণের তথা প্রতিরোধের জন্য সুশিক্ষা, শিশুর স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, লালন-পালন, পরিচর্যা, উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি, আনন্দময় জীবনযাপনের ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ প্রয়োজন। একই ধরনের কাজ অনেকক্ষণ ধরে করলে একঘেয়েমি আসে। ঐ কাজের প্রতি মানুষের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। দৈহিক ও মানসিক এই পরিবর্তনেকেই অবসাদ বলে। অবসাদ দুই ধরনের – দৈহিক ও মানসিক। অতিরিক্ত অঙ্গ সঞ্চালনের ফলে যে অবসাদ সৃষ্টি হয় তা হলো দৈহিক অবসাদ। অনেক সময় ধরে অংক করলে বা ছবি আঁকলে তা নির্ভুলভাবে করা যায় না বার বার ভুল হয়। এই ভুল হওয়াটাই হলো মানসিক অবসাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!