শাসন ও ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে মোগল আমলে নানা পদক্ষেপ

মোঘল আমলে শাসন ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার জন্য নানা পরিকল্পনা করে। এরমধ্যে শাসন ও ধর্মীয় সংস্কারের দিকে সকল শাসক গভীর মনযোগ দেয়।

আকবরের শাসন সংস্কার

১৫৬৯ খ্রীস্টাব্দে আকবর নির্দেশ দেন আগ্রা থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে বাবর যেখানে রাণা সঙ্গকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন সেই সিক্রিতে নতুন একটি শহর-নির্মাণের। ‘পাতশাহের’ হুকুম অনুযায়ী আকবরের দরবারের আমির ওমরাহরা আগে যেখানে ধু-ধু মাঠ ছিল সেই বিশাল প্রান্তরে বহুবিধ প্রাসাদ ও প্রমোদ-উদ্যান নির্মাণ করালেন। এইভাবে লাল বেলে-পাথরের তৈরি অপরুপ সুন্দর এক শহর গড়ে উঠল আর তা হল আকবরের রাজধানী। এই রাজধানীর নতুন নামকরণ হল ফতেপুর সিক্রি (বা ‘বিজয়নগর’)। এই শহরে শেখ সেলিম চিস্তি একদা যে-ঘরটিতে বাস করতেন (এই সেলিম চিস্তি আকবরের প্রথম পুত্রসন্তানের জন্ম সম্বন্ধে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন) সেখানে পরে একটি অট্টালিকা নির্মাণ করা হয় এবং বেশ কিছুকাল পরে তা পুনর্নির্মিত হয় শ্বেতপাথর দিয়ে। এই প্রাসাদটিই পরবতী মোগল-আমলে নির্মিত অন্যান্য শ্বেতপাথরের প্রাসাদ ও সমাধিসৌধের অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফতেপুর সিক্রি শহরটি যখন গড়ে উঠল তখন দেখা গেল শহরে জলের সরবরাহ যথেষ্ট নয়। একারণে ষোড়শ শতকের আশির দশকে আকবরের দরবার ফতেপুর সিক্রি পরিত্যাগ করে এলেন। শহরটি এখনও পর্যন্ত তেমনই শুন্য পড়ে আছে। শহরটি এখন অমূল্য স্থাপত্যশিল্পের এক নিদর্শন-সমাহার এবং অসংখ্য পর্যটকের তীর্থক্ষেত্রবিশেষ।

আকবর যখন প্রকান্ড এক সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে বসলেন তখন তিনি স্থির করলেন যে রাজ্যে শাসন ও ধর্মীয় সংস্কার করবেন; তাঁর গোটা প্রশাসন-ব্যবস্থাকে আঁটসাঁটও করে বেধে পোক্ত করে তোলার সময় হয়েছে। ফলে তাঁর পরবর্তী প্রশাসনিক সংস্কার-ব্যবস্থাগুলির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল তাঁর রাজবংশের শাসনকে দৃঢ়বদ্ধ করে তোলা এবং ভারত জুড়ে মুসলিম সামন্ত ভূস্বামীদের প্রাধান্য কায়েম করা। আবার সেইসঙ্গে বৈষম্যমূলক ধর্মীয় উৎপীড়নের বোঝা কিছুটা লাঘব করে তিনি চাইলেন দেশের হিন্দু, জনসাধারণেরও সমর্থন লাভ করতে। তবে তাঁর এই শেষোক্ত নীতির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালেন মুসলিম জায়গিরদার’ ও শেখরা, তাঁরা চাইলেন কঠোর নীতি অনুসরণ করতে এবং সকল অসন্তোষের প্রকাশকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে।

১৫৭৪ খ্রীস্টাব্দে সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণীর সকল অংশের মধ্যে সম্পর্ককে নিয়মিত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় আকবর সরকারি পদসমূহের (‘মনসব’গুলির) মধ্যে একটি ক্রমিক স্তরবিন্যাসের প্রবর্তন করলেন এবং তাঁর সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে তাঁদের পদ (বা ‘জাট)-অনুযায়ী ছোট থেকে বড় ‘জায়গির’ বিতরণ করলেন। তবে ‘জায়গিরদার’রা অবশ্য এবারেও আগেকার মতো উদ্ভাবন করে ফেললেন সম্রাটের হুকুমনামা এড়িয়ে যাওয়ার কলাকৌশল এবং সম্রাট-নির্দিষ্ট অর্থের চেয়ে কম অর্থ ব্যয় করতে লাগলেন তাঁদের সেনাবাহিনীগুলির ভরণপোষণের জন্যে। ফলে আরও কড়াকড়ি নিয়মকানুনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল এবং এবার নতুন একটি স্তরবিন্যাসের প্রবর্তন করা হলো। এই স্তরবিন্যাসকে বলা হলো ‘সাভার’’। তখনও অবশ্য ‘জাট’ দিয়ে সরকারি পদের ক্রমকে বোঝানো হতে লাগল, আর সাভার’ কথাটি দিয়ে বোঝানো হলো একজন সেনাধ্যক্ষ ঠিক কতজন অশ্বারোহী-সৈন্যের ভরণপোষণের ভার নিতে সরকারিভাবে বাধ্য তা-ই (যেমন, উদাহরণস্বরুপ, এক হাজার অশ্বারোহীর অধিনায়ক এক সেনাধ্যক্ষের এক হাজার, পাঁচ’শো, এমন কি মাত্র চার’শো অশ্বারোহীর ভরণপোষণ করণীয় বলে গণ্য ছিল)। ‘জায়গির’’এর আয়তন ক্রমে নির্ভর করতে শুরু করল ‘জায়গির’’-প্রাপকের ‘জাট’ ও ‘সাভার’’এর ওপর। এর ফলে বিলি-করা জমির আয়তন উঠল বেড়ে এবং খালিসা’-জমির তহবিল হ্রাস পেল।

আরো পড়ুন:  অনশন প্রসঙ্গে

এরপর আকবর স্থির করলেন যে জায়গির’-প্রথার একেবারে অবসান ঘটাবেন। তৎকালীন ইতিবৃত্ত থেকে আমরা জানতে পারি যে ১৫৭৪ খ্রীস্টাব্দেই আকবর তিন বছরের জন্যে একটি পরীক্ষামূলক পরিকল্পনা কার্যকর করার নির্দেশ দেন, যে-পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল রাষ্ট্রীয় ভূ-সম্পত্তিই খালিসা জমি হিসেবে গণ্য হবে এবং বাদশাহ, তাঁর সেনাধ্যক্ষদের বেতন দেবেন অর্থমূল্যে। সেইসঙ্গে আকবর স্থির করেন যে ভূমি রাজস্ব অতঃপর আদায় করবেন ‘ক্রোরি’ নামের রাজকর্মচারিরা। এই কর্মচারিদের নিজেদেরই মোটা একটা টাকা অগ্রিম জামিন হিসেবে দিতে হয়েছিল। এই প্রশাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে হস্তচ্যুত তালুকের মালিক ‘জায়গিরদারদের পক্ষ থেকে প্রবল বাধার সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে ‘রায়তরাও আরও দরিদ্র হয়ে পড়েন। এই শেষোক্ত ব্যাপারটি ঘটে এই কারণে যে তিন বছরের জন্যে নিযুক্ত উপরোক্ত নতুন রাজস্ব-আদায়কারীরা তাঁদের জামিনের টাকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এবং তার ওপর যতটা সম্ভব বেশি লাভ করার উদ্দেশ্যে ‘রায়ত’দের কাছ থেকে যতটা যা পাচ্ছিলেন আদায় করে নিচ্ছিলেন।

আকবরের ধর্ম-সংস্কার ব্যবস্থা

প্রশাসনিক অন্যান্য পরিবর্তনগুলি সাধন করেছিলেন আকবর যে-উদ্দেশ্যে তাঁর প্রবর্তিত ধর্মসংস্কারগুলিরও উদ্দেশ্য ছিল তা-ই, অর্থাৎ তা হলো তাঁর রাজক্ষমতার সামাজিক ভিত্তিকে আরও প্রসারিত করা। আকবর বুঝেছিলেন যে হিন্দুরা একমাত্র তাহলেই একনিষ্ঠভাবে তাঁর সেবা করবেন যদি তিনি তাঁদের ধর্মীয় আচার-ব্যবহারের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করেন। এই কারণেই ১৫৬৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি হিন্দু, তীর্থযাত্রীদের দেয়া কর-ব্যবস্থা বাতিল করে দেন এবং এর পরের বছর বাতিল করে দেন “জিজিয়া’কর। যতদূর মনে হয়, মুসলিম জায়গিরদারদের চাপের ফলে এই দুটি কর-ব্যবস্থা ফের একবার চালু করা হয়, তবে ১৫৮০’র দশকের সুচনায় আবার বাতিল হয়ে যায় এই কর দুটি।

আকবরের প্রবর্তিত নতুন ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে রক্ষণশীল উচ্চপদস্থ মুসলিম ধর্মনেতাদের আপত্তি দেখে রক্ষণশীল ইসলাম ধর্মের সঠিকতা সম্বন্ধেই আকবরের সন্দেহ জন্মায়। ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে ফতেপুর সিক্রিতে একটি উপাসনালয় (বিশেষভাবে ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়। এখানে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আলোচনাসভায় প্রচণ্ড তর্ক-বিতর্কের বহর দেখে আকবর ক্রমশ রক্ষণশীল ইসলাম ধর্ম থেকে দূরে সরে যান। ওই সময়ে আকবরের একজন প্রধান বন্ধু ও অন্যান্য নানা ব্যাপারের সঙ্গে ধর্মীয় সমস্যাদির ক্ষেত্রেও তাঁর উপদেষ্টা ছিলেন আবুল ফজল। আবুল ফজলের বাবা শেখ মুবারক তার মাহদি’-মতবাদ প্রচারের জন্যে নিগৃহীত হয়েছিলেন এবং বালক বয়সে আবুল ফজলকে বাবার সঙ্গে দেশান্তরী হয়ে নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। আবুল ফজুল নিজে সুফীবাদের এক অত্যন্ত উদারনৈতিক রকমফেরের প্রবক্তা ছিলেন এবং আনুষ্ঠানিক মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান তিনি। তাঁর মত ছিল এই যে সকল ধর্মের পথই হলো ঈশ্বর-সন্ধান এবং প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই আছে সত্যের কিছু-না-কিছু উপাদান। আবুল ফজল আকবরের মধ্যে জাগিয়ে তোলেন যেমন অ-মুসলিম ধর্মগুলি সম্বন্ধে তেমনই নানা ধর্মবিরোধী মতবাদ সম্বন্ধেও আগ্রহ। ওই সময়ে এই শেষোক্ত মতবাদগুলি ছিলো সামন্ততন্ত্রের কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে জনসাধারণের বিরোধিতার তাত্ত্বিক রূপ।

আকবরের ইবাদতখানায় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা

আন্তরিকভাবেই বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠে আকবর পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেন হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে এবং সেইসঙ্গে পারসি, জৈন ও ক্রিস্টিয়ান ধর্মের সঙ্গেও। তাঁর অনুরোধে জেসুইট ক্রিস্টিয়ানদের তিনটি প্রতিনিধিদলকে গোয়া থেকে তাঁর দরবারে পাঠানো হয়। এইরকম একটি ধর্মীয় দলের নেতা মনসেররাতে ‘মন্তব্য’ নাম দিয়ে কিছু টুকরো বিবরণী লিখে রেখে যান। এই বিবরণীগুলি দারুণ মূল্যবান বলে ইতিহাসবেত্তাদের কাছে গণ্য। আকবর ওই সময়ে তাঁর দরবারে হিন্দু ও ফারসি নিয়মকানুন চালু করতে শুরু করেন।

আরো পড়ুন:  কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টি ছিলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক দল

এর ফলে ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দে এক ব্যাপক অভ্যুত্থানের সূচনা হয় এবং আকবর সাংঘাতিক বিপদের সম্মুখীন হন। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন শেখরা। তাঁরা এই মর্মে এক ফতোয়া বা ধমীয় নির্দেশ জারি করেন যে আকবর ধর্মদ্বেষী, অতএব তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করতে হবে। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্র ছিল বাংলা ও পঞ্জাব, সেখানকার বিদ্রোহী সামন্ত-ভূস্বামীরা মোগল-সিংহাসনের সম্ভাব্য অধিকারী (অবশ্যই তাঁদের পছন্দমতো) বলে ঘোষণা করেন কাবুলস্থিত আকবরের শাসক প্রতিনিধি ও অপর এক স্ত্রীর গর্ভজাত হুমায়ুনের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রকে। অনেক কষ্টে তবে আকবর এই অভ্যুত্থান দমনে সফল হন। বিজয়ী হয়ে আগ্রায় ফেরার পর আকবর তাঁর দরবারে এক নতুন ধর্মমতের প্রবর্তনা শুরু করলেন। এই ধর্মের নাম দিলেন তিনি ‘দীন-ই-ইলাহি’ (বা দিব্য বিশ্বাস)। এই ‘দীন-ই-ইলাহি’ ধর্মের মধ্যে আকবর একীভূত করতে চেয়েছিলেন ভারতের প্রধান-প্রধান ধর্মমতগুলির মধ্যে যে-উপাদানগুলিকে তিনি যুক্তিসম্মত বলে মনে করেছিলেন সেই সমস্ত উপাদানকে। এই ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে প্রধান কয়েকটি ব্যাপার ছিল এই রকম: ‘মাহদিবাদীদের ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আকবরকে ন্যায়বিচারক সম্রাট বলে তাঁর গুণকীর্তন করা এবং হিন্দুধর্মের কিছু ও মুসলিম ধর্মেরও কিছু পরিমাণে আচার-বিচার, পূজা-পদ্ধতি ও পুরাণকথাকে খানিকটা অস্বীকার করা।

কৃত্রিমভাবে জোড়াতাড়া-দিয়ে-তৈরি আকবরের এই ধর্মমতের সপক্ষে সমর্থন জুটল প্রধানত জনসমাজের দরিদ্রতর অংশগুলির মধ্যে থেকেই, যদিও আকবরের আশা ছিল তাঁর দরবারের নানা মহলকে এই ধর্ম বুঝি আকর্ষণ করতে পারবে। অতঃপর আর কোনো বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান না-ঘটলেও আকবরের ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু, মুসলিমদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সমানে চলল। এ-থেকেই বোঝা যায় কেন তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলিতে আকবর মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার শেখদের নির্বাসিত করছিলেন সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে, বন্ধ করে দিচ্ছিলেন কিছু কিছু, মসজিদ, ইত্যাদি। আকবরের মত্যুর পর ‘দীন-ই-ইলাহি আরও অর্ধশতাব্দীর মতো টিকে ছিল ছোট একটি সম্প্রদায়ের আচরিত ধর্ম হিসেবে। তবে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মর্মবাণীটি এবং ভারতের দুটি প্রধান ধর্মকে পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্নিবেশিত না করে বরং সে-দুটিকে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ করে তোলার উপায়াদি সন্ধান ও এক ধরনের একটি সংশ্লেষণ অর্জন যা নাকি ছিল আকবরের উদ্দিষ্টতা ভারতীয় সমাজকে প্রভাবিত করেছিল গভীরভাবে।

আরো পড়ুন:  সেলুলার জেলের ফলক থেকে উধাও তিন শতাধিক বাঙালিসহ ৪৫৩ জন বিপ্লবীর নাম

আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি

আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণের ফলে ‘জায়গিরদার’দের মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রতিক্রিয়াশীল মহলগূলি অতঃপর মোগল-দরবারে জাঁকিয়ে বসল, সর্বব্যাপারে তাদের প্রভাব হয়ে দাঁড়াল নির্ধারক। ঠাণ্ডামাথা ও হিসেবী রাজনীতিক আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মান্ধ মুসলমান এবং দারা শুকোহের বিরুদ্ধে তাঁর বিজয় সুচিত করেছিল এমন এক রাষ্ট্রনীতির, যার মূলকথা ছিল হিন্দুদের সকল অধিকার হরণ ও শিয়া মতাবলম্বী মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন। দেশের জীবনযাত্রাকে ইসলামের শিক্ষা-অনুযায়ী ঢেলে সাজার উদ্দেশ্যে আওরঙ্গজেব শিয়া মতাবলম্বীদের উৎসবগুলি নিষিদ্ধ করে দিলেন এবং বন্ধ করে দিলেন মদ্যপান, গান-বাজনা, ছবি আঁকা, নৃত্য, ভাঙের গাছ রোপণ, ইত্যাদি। ১৬৬৫ থেকে ১৬৬৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে তিনি হুকুম দিলেন হিন্দু-মন্দিরগুলিকে ভেঙে ফেলতে ও সেগুলির ধংসস্তুপের ওপর মসজিদ বানাতে। হিন্দুদের পক্ষে মর্যাদাচক কোনো চিহ্ন ধারণ করা, হাতির পিঠে চড়া, ইত্যাদি নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

সবচেয়ে গুরুতর বোঝা স্বরূপ ছিল অ-মুসলমানদের ওপর চাপানো মাথাপিছু কর বা “জিজিয়া”। আকবরের উঠিয়ে-দেয়া এই করের পুনঃপ্রবর্তন করেন আওরঙ্গজেব ১৬৭৯ খ্রীস্টাব্দে। এর ফলে গণ-বিদ্রোহ দেখা দেয় দিল্লী, গুজরাট, বুরহানপর, ইত্যাদি জায়গায়। মারাঠা, রাজপুত, জাঠ, ইত্যাদিরা ফুসে উঠলেন বিদ্রোহে। আফগান মুসলমানরাও বিদ্রোহ করলেন। মোগল-শাসনের কবল থেকে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা অর্জনের এই তাগিদ ছিল ভারতের বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয় সচেতনা উন্মেষের প্রথম লক্ষণ। এই জাতিগুলি মোগাল-রাষ্ট্রকে পরক ও উৎপীড়ক জ্ঞান করতে লাগলেন, জ্ঞান করতে লাগলেন তাঁদের ধর্মীয় মনোভাবের পক্ষে প্রায়শই বিঘ্নসৃষ্টিকারী হিসেবে। এই সমস্ত গণআন্দোলনের ফলে মোগল-সাম্রাজ্যের ক্ষমতার ভিত্তি গেল ধসে।

তথ্যসূত্র:

১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩২৭-৩৩১।  

Leave a Comment

error: Content is protected !!