আদি যুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত এশিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস প্রসঙ্গে

প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত এশিয়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে। এশিয়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস বলতে আমরা চীন, ভারত, বাংলাদেশ পশ্চিম এশিয়া ও জাপানের ইতিহাসকে প্রধানত বুঝে থাকি।

ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস সূচিত হয়েছে সিন্ধু সভ্যতা হতে গোড়ার দিকের রাজ্য এবং সাম্রাজ্যেগুলোর প্রাগৈতিহাসিক মানবিক ক্রিয়াকলাপের প্রারম্ভ থেকে। ভারতে সিন্ধু সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দের দিকে শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে।

বস্তুত, ভারতে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম এবং গ্রিসে পঞ্চম শতক থেকে দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ তথা বিজ্ঞানীদের নাম পাওয়া যায়। সেকালের বিচারে তারা অবশ্যই বিজ্ঞানের এক একজন অগ্রপথিক। প্রাচীন ভারতীয় গণিতে উজ্জ্বলতম নাম আর্যভট, ব্রহ্মগুপ্ত, বরাহমিহির,ভাস্করাচার্য প্রমুখ।

গুপ্তযুগের সূচনায় পাটলিপুত্রে (বর্তমান পাটনা) আনুমানিক ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে আর্যভটের জন্ম হয়। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি রচনা করেন গণিতের অমূল্য গ্রন্থ ‘আর্যভটীয়’। আসলে এটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা মাত্র। মােট ১২৩টি শ্লোকে গাঁথা চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলি হলো: দশগীতিকা, গণিতপাদ, কালক্রিয়া ও গোলপাদ । গণিতপাদে বর্গমূল, ঘনমূল, সমান্তর শ্রেণি, সমীকরণ সমাধান ইত্যাদি বিষয় আলােচিত। আর্যভটীয়তে π (pai)-এর যে মান (৩.১৪১৬) নির্ণীত হয়েছে, তা প্রায় নির্ভুল। এই পুস্তিকার অন্য তিনটি অধ্যায়ে রয়েছে জ্যোতিষ তথা জ্যোতির্বিদ্যায় আর্যভটের গবেষণার ফলাফল। পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথাও বলেছেন আর্যভট। এই অগ্রপথিকের সম্মানে ভারতের তৈরি প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের নাম রাখা হয় ‘আর্যভট’।

ব্রহ্মগুপ্তের আবির্ভাব আনুমানিক ৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে। তার জন্মস্থান উজ্জয়িনী। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় উজ্জয়িনী তখন ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান কেন্দ্র। ব্রহ্মগুপ্তের গবেষণা তথা কর্মকেন্দ্রও ছিল উজ্জয়িনী। ত্রিশ বছর বয়েসে তিনি রচনা করেন গণিত ও জ্যোতিষের এক মহাগ্রন্থ ‘ব্রহ্ম-স্ফুট-সিদ্ধান্ত’। মূলত ‘আর্যভটীয়’-র উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও, এই গ্রন্থে তাঁর নিজস্ব আবিষ্কারের কথাও লিখে গিয়েছেন ব্রহ্মগুপ্ত। বস্তুত, গণিতে তার স্বকীয়তা আর্যভটকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাস দাস যুগ থেকে বিশ্বের ইতিহাসের সংগে পুঁজিবাদ পর্যন্ত বিরাজমান

ভাস্করের জন্ম আনুমানিক ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রাচীন হিন্দু গণিতজ্ঞদের মধ্যে তাকে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ৩৬ বছর বয়েসে ভাস্কর তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত শিরােমণি’ রচনা করেন। এর চারটি খণ্ড: লীলাবতী, বীজগণিত, গণিতাধ্যায় ও গােলাধ্যায়। শেষ দুটি খণ্ডে রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলােচনা। লীলাবতী হলো পাটীগণিত, যা একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং গণিতজগতে আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। কোনও বৃহৎ গণনা অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে সম্পন্ন করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন ভাস্কর। যার মধ্যে আজকের ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাসের আভাস মেলে। এর প্রায় ৫০০ বছর পরে আধুনিক ক্যালকুলাস উদ্ভাবন করেন নিউটন এবং লাইবনিৎজ।

শূন্য (zero)-এর আবিষ্কার বিশ্বগণিতে ভারতের অনন্য অবদান। প্রায় একই সময়ে দশমিক অঙ্কপাতন পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়। দ্বিতীয় বা প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দে শূন্য আবিষ্কৃত হয় বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান। কিন্তু আবিষ্কারক কারা ছিলেন, তা অজ্ঞাত।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকেই ভারতে পরমাণুর ধারণা ছিল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে যে ধারণাকে সুগ্রথিত করেন কণাদ। যেখানে মৃত্তিকা, জল, বায়ু, আকাশ বা শূন্যদেশ ও অগ্নিকে বিশ্বসৃষ্টিকারী পাঁচ মৌলিক পদার্থ ধরা হয়েছে। এবং প্রত্যেক মৌলের ক্ষুদ্রতম অংশকে বলা হয়েছে পরমাণু (পরম অণু)। প্রায় একই সময়ে গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ডেমক্রিটাস পদার্থের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য কণাকে ‘অ্যাটম’ বা পরমাণু বলে সংজ্ঞায়িত করেন। অবশ্যই কণাদ ও ডেমক্রিটাস কেউ কারও তত্ত্ব জানতেন না।

প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা তথা আয়ুর্বেদ (‘আয়ু’ অর্থে জীবন, ‘বেদ’ অর্থে জ্ঞান) অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম নাম: আত্রেয়, অগ্নিবেশ, সুশ্রুত, চরক, নাগার্জুন, জীবক প্রমুখ। সুশ্রুত ও চরক সম্পর্কে এই বইয়ে বিস্তারিত আলােচনা রয়েছে। আত্রেয়, অগ্নিবেশ, সুশ্রুত সমসাময়িক। জীবক আয়ুর্বেদের যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসক ছিলেন তিনি। তিন জন নাগার্জুনের কথা জানা গিয়েছে। এঁদের মধ্যে খ্রিস্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকের নাগার্জুনই বিখ্যাত। সুশ্রুত সংহিতা নতুন করে লিখেছিলেন তিনি।

আরো পড়ুন:  বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানের চর্চা

আলোকচিত্রের ইতিহাস: মহীশুর রকেট নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে লড়াই করতে মহীশুর সেনাবাহিনীকে একটি চিত্রকর্মে দেখানো হচ্ছে।

তথ্যসূত্র:

১. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৩-১৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!