ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস হচ্ছে ১৯২০ সাল থেকে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস। লেনিনের আমন্ত্রণে মানবেন্দ্রনাথ নবগঠিত কমিন্টার্নের মস্কোয় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১৯২০ সালে যােগদান করেন। উপনিবেশগুলিতে কমিউনিস্টদের ভূমিকা সম্পর্কে ভ. ই. লেনিনের সঙ্গে বিতর্কে মানবেন্দ্রনাথের সম্পূরক থিসিসসমূহ কয়েকটি সংশােধনের পর গৃহীত হয়। অনতিকালের মধ্যে কিছু ভারতীয় বিপ্লবী ও খিলাফতিদের নিয়ে মানবেন্দ্রনাথ তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন ১৭ অক্টোবর ১৯২০ তারিখে; বার্লিনে পার্টির সদর দপ্তর খােলা হয়।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের পর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকে লেনিন তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক সংক্ষেপে কমিন্টার্ন গঠন করেন। কমিন্টার্নের পরিচালনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্প্রসারণের কর্মসূচি গৃহীত হয়। এর কিছুকাল আগে মেক্সিকোয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় মার্কসবাদী দর্শনে দীক্ষিত হয়ে রুশ দেশের বাইরে প্রথম একটি কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
‘ভ্যানগার্ড’ নামক পত্রিকা ও চিঠিপত্র পাঠিয়ে এবং দূত মারফৎ মানবেন্দ্রনাথ ইউরােপ থেকে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গােড়াপত্তন করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে নতুন কর্মসূচির খসড়া প্রস্তাব ও ইশতেহার পাঠানাে ছিল তাঁর নিয়মিত একটি কাজ। ক্রমে বিভিন্ন সংগঠনের সাহায্যে কলকাতা (মজফ্ফর আহমেদ), বােম্বাই (ডাঙ্গে), মাদ্রাজ (সিঙ্গারভেলু), কানপুর (উসমানি) ও লাহােরে (গােলাম হুসেন) কমিউনিস্ট কেন্দ্র গড়ে ওঠে। পেশওয়ার ও কানপুর যড়যন্ত্র মামলায় সরকার নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে সত্যভক্তের উদ্যোগে একটি আইনানুগ কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়, যার সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় কমিউনিস্টরা যুক্ত থাকলেও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না। পরে সত্যভক্তের সঙ্গে দলের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
১৯২০ সালের কুড়ির দশকের শেষদিকে ভারতে কমিউনিস্টরা শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে ১৯২৬ সালে ওয়াকার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টি নামে গঠিত (১৯২৬) সংগঠনের অন্তরালে কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। অবৈধ ছিল বলে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ চলত গােপনে। অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পরে জাতীয় কংগ্রেসের নিষ্ক্রিয়তা ও স্বরাজ্য দলের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি অনুসরণের ফলে কংগ্রেসের সংগ্রামী সম্ভাবনা সম্পর্কে মানবেন্দ্রনাথের মনে যে নৈরাশ্য দেখা দিয়েছিল ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বিরােধী আন্দোলনে বামপন্থী নেতৃত্বের উত্থান দেখে সেটা কেটে যায়। তিনি কমিউনিস্টদের কংগ্রেসে যােগ দিয়ে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের প্রভাবাধীন বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তােলার আহ্বান জানান।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে যষ্ঠ কংগ্রেসের সময় কমিন্টার্নের মধ্যে স্তালিনের পক্ষে ও বিপক্ষে প্রবল এক গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলেছিল। শেষাবধি স্তালিনের অনুগামীরাই ক্ষমতা দখল করেন; এবং এযাবৎকাল লেনিন-অনুসৃত যুক্তফ্রন্ট নীতি পরিত্যাগ করে কমিন্টার্ন একটি উগ্র অতিবাম কর্মপন্থা গ্রহণ করে। সে সময়ে ইউরােপে ফ্যাসিবাদের বিস্তার ঘটে চলেছিল। স্তালিনপক্ষীয়রা বুখারিনের বিরুদ্ধে মানবেন্দ্রনাথকে নিজেদের দলে টানতে না পেরে মানবেন্দ্রনাথের প্রবন্ধাদি কমিন্টার্নের পত্রপত্রিকায় প্রকাশের সুযােগসুবিধা বন্ধ করে দেন। ফলে মানবেন্দ্রনাথ জার্মানিতে বিক্ষুব্ধ বিরােধী কমিউনিস্টদের পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন; বিক্ষুব্ধ পক্ষের পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার দায়ে কমিন্টার্ন থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন ১৯২৯ সালে।
অতঃপর কমিন্টার্নের নির্দেশে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিও উগ্র অতিবাম কর্মসূচি গ্রহণ করে। শ্রমিক-কৃষক নেতৃত্বে অবিলম্বে বিপ্লবের পথে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত হয়। কংগ্রেসের নেহরু-সুভাষ-আয়েঙ্গার প্রমুখ বামপন্থীদের বিরুদ্ধে তীব্র ও কটু ভাষায় সমালােচনা শুরু হয়। এর আগে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সরকার ওয়াকার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টির ৩১ জন নেতা যাঁরা ছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরােধা তাঁদের সহসা গ্রেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে মিরাট ষড়যন্ত্র নামে এক মামলা রুজু করে। ত্রিশের দশকে কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনকে কমিউনিস্টরা একটি বুর্জোয়া ক্রিয়াকৌশল বলে প্রচার করেন।
১৯৩৫ খ্রি কমিন্টার্নের সপ্তম কংগ্রেসে বিশ্ব পরিস্থিতির দ্রুত অবনতিদৃষ্টে নিজেদের ভ্রান্তি উপলব্ধি করে পূর্বতন যুক্তফ্রন্ট নীতির পুনরাবর্তন ও উগ্র বামঘেঁষা নীতি পরিহার করা হয়। নতুন পপুলার ফ্রন্ট কর্মসূচি গ্রহণের ফলে ভারতীয় কমিউনিস্টরা অতঃপর কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টি বা সি এস পি’র সমালােচনা বন্ধ করে ওই দলে যােগদান করেন এবং ওই দলের মধ্যে দিয়ে পরােক্ষে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন।
সি এস পি-র ছত্রছায়ে এবং এ আই টি ইউ সি, ভারতীয় কিষাণ সভা, ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি শক্তি সঞ্চয় করে চলে। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধে জার্মানি কর্তৃক রাশিয়া আক্রান্ত হবার মাস ছয়েক পরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধের ফ্যাসিবিরােধী স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে যুদ্ধের সমর্থনে নতুন নীতি গ্রহণ করে ১৯৪২ সালে। সরকার অচিরে কমিউনিস্ট পার্টিকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়। যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্টদের বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৭ খ্রি ভারতের জাতীয় স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে পার্টির মধ্যে প্রবল মতদ্বৈধ ছিল।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতায় সি পি আই-এর দ্বিতীয় কংগ্রেসে পি সি যােশীর নরমপন্থী কর্মসূচি পরিহার করে বি টি রণদিভের নেতৃত্বাধীনে বিপ্লবী কর্মসূচি গৃহীত হয়। অন্ধ্রের তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে পার্টি বে-আইনি ঘােষিত হয়, নেতারা কারারুদ্ধ হন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে অন্তর্দলীয় বিতর্কে রণদিভের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তীব্র হয়ে পড়ায় তাঁর পরিবর্তে সি রাজেশ্বর রাও সেক্রেটারি হন ও নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। রাজেশ্বর রাও-এর চীনপন্থী বিপ্লবের মডেল অনুযায়ী মধ্য বুর্জোয়া ও ধনী কৃষকদেরও বিপ্লবের যুক্তফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিস্থিতি সশস্ত্র বিপ্লবের আদৌ অনুকূল নয় বলে ডাঙ্গে অভিমত প্রকাশ করেন। তাঁকে ব্রিটিশ নেতা রজনী পাম দত্ত সমর্থন করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পার্টিতে মধ্যপন্থীরা শক্তিসম্পন্ন হন। অজয় ঘােষকে জেনারেল সেক্রেটারি করা হয় ।
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাদুরাইতে পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে নিয়মতান্ত্রিক ও সংসদীয় কর্মসূচি অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়, ফলে পার্টি একটি প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী পার্টিতে রূপ নেয়। গণশত্রু খুনি নেহরু সরকারকে সমর্থনের সুপারিশ আসে রজনী পাম দত্ত ও প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় থেকে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পালঘাটে চতুর্থ কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয় ভারতীয় জনগণের শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে কার্যকলাপকে সমর্থন করা হবে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কেরলে প্রথম একটি কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়। অমৃতসরে অনুষ্ঠিত পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে জাতীয় কংগ্রেস দল পরিচালিত সরকার ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে যুগপং লড়াই চালানাের সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সােভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনবাদের প্রভাব দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে এবং রুশ ও চীনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। হাঙ্গেরির ঘটনা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বাম ও দক্ষিণ ঘেঁষা নেতৃবৃন্দ যথাক্রমে চীন ও রাশিয়ার প্রতি সমর্থন এবং মতাদর্শ, মৌলিক ক্রিয়াকৌশল ও কর্মসূচির পার্থক্যের ভিত্তিতে দুটি স্বতন্ত্র দলে বিভক্ত হয়ে যান (১৯৬৪)। নবগঠিত সি পি আই (মার্কসবাদী) দল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান জানায়। পুরানাে সি পি আই দল নিজেদেরকে গণবিরোধী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতেই আবদ্ধ থাকে। পুরানাে দলকে নতুন সি পি আই (এম) দল শােধনবাদী বা অভিযুক্ত করে যদিও আমরা দেখব দুই দলই সংশোধনবাদের সেবা করবে এবং কংগ্রেসকে ক্ষমতায় রাখতে আজিবন চেষ্টা চালাবে।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের পরও সি পি আই-তে একাধিক উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে। একটি হলো পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা অমৃত ডাঙ্গের অপসারণ এবং তাত্ত্বিক নেতা মােহিত সেনের বহিষ্কার। পার্টির মতাদর্শ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে এন ই বলরামের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে হায়দ্রাবাদে পাটির পঞ্চদশ কংগ্রেসের পূর্বেই জাতীয় পরিষদে কমিশনের সুপারিশগুলি নাকচ হয়ে যায়। গৃহীত প্রস্তাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পথনির্দেশ, সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা ইত্যাদি কর্মসূচির উপর গুরুত্ব আরােপিত হয়। পার্টির একটি অংশ সি পি আই (এম) দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। সে জন্য শেষােক্ত দলের সাধারণ সচিব হরকিষেণ সিং সুরজিৎকে অধিবেশনে ভাষণদানের জন্য বিশেষ অনুরােধ জানান হয়।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭২-৭৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।