জাহাঙ্গীরের আমালে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ
মোগল আমলের শুরু সপ্তদশ শতক থেকে; সেই সময় মোগল-সম্রাটরা সমগ্র দক্ষিণ-ভারত নিজেদের পদানত করার আশা ত্যাগ করেন নি। ওই সময়ে মোগল-সেনাবাহিনীর দাক্ষিণাত্য-অভিযান শুরু করার পক্ষে প্রধান অগ্রসর ঘাঁটি ছিল গুজরাট। আহমদনগর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা-রাজ্য মোগলদের বশ্যতাস্বীকারে রাজি ছিল না। এই তিনটি রাজ্য সর্বদাই নিজেদের সীমানা-সংলগ্ন ভূখণ্ডের দাবি-দাওয়া নিয়ে পরস্পরের মধ্যে লিপ্ত থাকত যুদ্ধ-বিগ্রহে, তবে বিরল কোনো-কোনো ক্ষেত্রে মোগল-সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হতো।
মোগলরা দাক্ষিণাত্য-অভিযান শুরু করলেন সে-দেশের সবচেয়ে দুর্বল রাজা আহমদনগর আক্রমণের মধ্যে দিয়ে। তবে এই আক্রমণ শুরু হওয়ার ঠিক আগের অল্প কয়েকটি বছরের মধ্যে ইথিওপীয় দাস-রাজা মালিক অম্বরের প্রবর্তিত নানা সংস্কার সাধনের ফলে রাজ্যটি লক্ষণীয় রকম শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ১৬১৪ খ্রীস্টাব্দে মালিক অম্বর দেশের ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করে তা উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশে ধার্য করেছিলেন ও কৃষকদের পক্ষে সম্ভব করে তুলেছিলেন রাজস্ব দেয়া, আবার সেইসঙ্গে তিনি ব্যাপকভাবে তাঁর সেনাবাহিনীতে লড়াইয়ের ক্ষমতার জন্যে তৎকাল-বিখ্যাত মরাঠি সৈন্যদের ভর্তি করে নেয়া শুরু করেছিলেন।
সপ্তদশ শতকে এই মরাঠিরা এক উল্লেখ্য বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন ভারতের ইতিহাসে। মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ সমাজগুলিতে তখন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ক্রমশ চরমে উঠছিল এবং গ্রামীণ সমাজগুলির অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালী সদস্যরা ক্রমশ হয়ে উঠছিলেন ছোটখাটো সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী। ওদিকে মোগল-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ভূখণ্ডগুলি থেকে পশ্চিম সমুদ্রোপকূলের অভিমুখে বণিকদের ক্যারাভান-পথগুলি মরাঠা-ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। ফলে মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ সমাজগুলিতে অনেক আগে থেকেই অনুপ্রবেশ ঘটেছিল পণ্য-বনাম-মুদ্রার সম্পর্কের। জমি কেনাবেচা চলছিল, বলতে গেলে, অবাধ স্বাধীনতার সঙ্গে, যদিও আইনসঙ্গতভাবে একমাত্র গ্রামীণ সমাজের সদস্যদেরই অধিকার ছিল নিজেদের মধ্যে জমির স্বত্ব সহ সকল স্বত্ব বিক্রি করার।
হালকা অস্ত্রশস্ত্রে-সজ্জিত আহমদনগরের মরাঠি অশ্বারোহী বাহিনী শত্রুর বাহিনীগুলির ওপর বিদ্যুদবেগে আঘাত হানত, খাদ্য, ইত্যাদি সরবরাহে পূর্ণ গাড়িগুলিকে দিত ছত্রভঙ্গ করে এবং মোগলদের বিশাল অথচ জবড়জঙ্গ সেনাবাহিনীতে গুরুতর লোক ক্ষয় ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াত। মোগলদের এই সামরিক অভিযান চলেছিল ১৬০৯ থেকে ১৬২০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত, তবু এর মধ্যে মোগল-সৈন্য নতুন কোনো সাফল্য-অর্জনে সমর্থ হয় নি। কিন্তু বিজাপুর ও গোলকোল্ডার সহায়তা সত্ত্বেও আহমদনগর-রাজ্যের পক্ষে প্রতিরোধ আরও বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। রাজ্যটির ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বড়-বড় সেনাবাহিনী চলাচল করার ফলে রাজ্যটি এমনিতেই গিয়েছিল বিধস্ত হয়ে এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফলে জনসাধারণের শক্তিসামর্থ্যও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। ১৬২১ খ্রীস্টাব্দে আহমদনগরের রাজধানী দখল করেন মোগলরা। অতঃপর যে-শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় তাতে বলা হয় যে আহমদনগরের ভূখণ্ডের একটা অংশ প্রাপ্য হবে মোগলদের। দাক্ষিণাত্যের উপরোক্ত তিনটি রাজ্যকেই মোটা অর্থ খেসারত দিতে হয়। অতঃপর প্রায় দশ বছর মোগলদের সঙ্গে ওই অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকে।
শাহ জাহানের আমালে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ
দাক্ষিণাত্য অধিকার করাকে শাহ জাহান তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রের কাছাকাছি থাকার জন্যে, তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেন বুরহানপুরে। ওদিকে মালিক অশ্বরের মত্যুর পর ফের একবার আহমদনগরে সামন্ততান্ত্রিক বিবাদ-বিসংবাদ শুরু হয়ে যায়। তখন দরবারের কিছু কিছু ধর্মান্ধ মুসলমান ওমরাহের প্রভাবে পরে আহমদনগরের তৎকালীন শাসক তাঁর হিন্দু মরাঠি সেনাধ্যক্ষদের হত্যা করান।
মালিক অম্বরের ছেলে ফতে খাঁ-কেও তিনি কারারুদ্ধ করেন। মোগল-বাহিনী যখন আহমদনগরের বেশ কয়েকটি দুর্ভেদ্য দুর্গ অধিকার করে নিল তখন আহমদনগরের সুলতান ফতে খাঁ’কে মুক্তি দিয়ে তাঁকে প্রধান উজির হিসেবে নিযুক্ত করলেন। কিন্তু ফতে খাঁন সুলতানকে হত্যা করে ও রাজ্য দখল করে মোগলদের পক্ষে যোগ দিলেন ও চাকুরি নিলেন মোগলদের অধীনে। এইভাবে স্বাধীনতা হারাল আহমদনগর (৯৬৩২ খ্রীস্টাব্দে)।
অতঃপর মোগল আমল-এর শাসকরা বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন। দু’বার ওই রাজ্যের রাজধানী মোগল-সৈন্যের দ্বারা অবরুদ্ধও হলো, কিন্তু মোগল-শিবিরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার (আশপাশের গ্রামের দুর্ভিক্ষপীড়িত নিঃস্ব কৃষকরা মোগলসৈন্যদের খাদ্য যোগাতে অসমর্থ হওয়ার) এবং মোগল-সেনাপতিদের মধ্যে নানা ব্যাপারে মতভেদ দেখা দেয়ায় শেষপর্যন্ত মোগল বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে।
১৬৩৬ খ্রীস্টাব্দে মোগল আমল-এর শাসকরা ফের একবার যুদ্ধাভিযান সংগঠিত করলেন দাক্ষিণাত্যের বিরুদ্ধে। ওদিকে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি তখনও আগের মতো লিপ্ত ছিল পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহে। এইসব রাজ্যের দরবারগুলিও ছিল ষড়যন্ত্র ও হানাহানিতে পূর্ণ, সামন্ত-ভূস্বামীরা একে অন্যকে হত্যা করায় ব্যস্ত। এই সুযোগে মোগল-বাহিনী ওই সমস্ত দেশের ওপর দিয়ে অব্যাহত গতিতে জয় যাত্রায় এগিয়ে চলল আর পেছনে ফেলে রেখে গেল বিধস্ত শহর আর গ্রাম। বিজাপুর আর গোলকোল্ডা যথেষ্ট সবলভাবে প্রতিরোধ করতে সমর্থ হলো না, ফলে তাদের মেনে নিতে হলো মোগল আমল-এর সাম্রাজ্যের অধীনে সামন্ত-রাজ্যের অবস্থা এবং নতুন সার্বভৌম শাসককে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ খেসারত ও বার্ষিক সেলামি দিতে বাধ্য হতে হলো।
শাহ জাহানের তৃতীয় পুত্র আওরঙজেব নিযুক্ত হলেন দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা। এই যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষধস্ত দেশে ভূমি-রাজস্ব সংগ্রহের ব্যাপারটি নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে আওরঙ্গজেবের ‘দেওয়ান’ (ভূমি-রাজস্ব বিভাগের প্রধান) মুর্শিদকুলি খাঁ খাজনা ধার্য করার এক নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এই পদ্ধতিটি ‘মুর্শিদকুলি খানী ধারা’ নামে পরিচিত। এই নতুন পদ্ধতি চালু করার উদ্দেশ্য ছিল ‘রায়ত’দের পরিত্যক্ত জমিগুলিতে এসে বসবাস করা ও চাষ-আবাদ করার জন্যে ‘তকাবি’ বা ‘আগাম’ টাকা দাদন দিয়ে তাঁদের আকৃষ্ট করা। সেচের ব্যবস্থাযুক্ত জমির ওপর নিচুহারে খাজনা ধার্য হলো, দেয় রাজস্বের পরিমাণ হিসাব করার প্রথা প্রবর্তিত হলো রাজকর্মচারি ও ‘রায়ত’দের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে, অর্থাৎ রাজস্ব দেয়ার ব্যাপারে কৃষকদের সামর্থও ধরা হলো হিসাবের মধ্যে। যদিও পরে দাক্ষিণাত্যের সামন্ত-ভূস্বামীরা প্রধান ভূমি-রাজস্য ছাড়াও প্রায় চোদ্দটির মতো অতিরিক্ত ধরনের কর কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তবু মুর্শিদকুলি খানী ধারা চালু করার ফলে দাক্ষিণাত্যে চাষ-আবাদের ক্রমিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছিল।
তথ্যসূত্র:
১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩৩৮-৩৩৯ ও ৩৪৩-৩৪৫।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।