মহামন্দা ছিল একটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা যা ১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়

মহামন্দা (ইংরেজি: The Great Depression) ছিল একটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা যা বেশিরভাগ ১৯৩০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু হয়েছিল। মহামন্দার সময় বিভিন্ন দেশ জুড়ে ভিন্নভাবে চোখে পড়ে; বেশিরভাগ দেশগুলিতে এটি ১৯২৯ সালে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৩০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম, গভীরতম এবং সবচেয়ে বিস্তৃত মন্দা।[১] বিশ্ব অর্থনীতি কত দ্রুত হ্রাস পেতে পারে তার উদাহরণ হিসাবে সাধারণত মহামন্দা শব্দটি ব্যবহৃত হয়।[২]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ১৯২৯ সালের অক্টোবর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ছন্দপতন দেখা দিয়েছিল, অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বড় আকারের সেই ছন্দপতনকে মহামন্দা তথা দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে জার্মানির ধ্বংসস্তুপের বিপরীতে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিমান রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে অন্যদের ওপর দাপট দেখাতে শুরু করে। একইসাথে রেনেসাঁ-পরবর্তীকালে পশ্চিমা বিশ্বে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে পুঁজিবাদ। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়মই হচ্ছে এখানে মাঝে মাঝে মন্দাভাব দেখা দেয়। তবে ঝড়ের বেগে এসে এই মন্দাভাব ও পুরাে বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রাস করবে, তা ছিল কল্পনাতীত।[৩]  

মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি

মহামন্দা তথা দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন উপনীত হওয়ার অনেকগুলাে শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে বেড়ে যায় বেকার ও চাকরি প্রত্যাশী মানুষের সংখ্যা। ১৯২৯ সালের এই মন্দা অতীতে ঘটে যাওয়া সব ধরনের রেকর্ড ভঙ্গ করে। আর সেদিক থেকে ধরতে গেলে এর মহামন্দা নামকরণ স্বার্থক। এর প্রমাণ হিসেবে এক যুক্তরাষ্ট্রেই ১৯২৯-৩৫ সালের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ব্যাংক বন্ধ ঘােষণা করতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মােটরস প্রতিবছর পাঁচ মিলিয়ন গাড়ি তৈরি করত। তবে ১৯৩২-এ দেখা যায় এর গাড়ি নির্মাণের সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব বাজারে গাড়ির চাহিদা না থাকায় এমনটি হয়েছিল। আর তা থেকেই ধরে নেয়া যায় মহামন্দার প্রভাব পুরাে বিশ্বে পড়েছিল। 

আরো পড়ুন:  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণক্ষেত্র এবং প্রচারণাগুলো হচ্ছে যুদ্ধের ধরন, রণক্ষেত্র এবং প্রচারণার রূপ

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে মহামন্দা সৃষ্টি হয়েছিল। শিল্পখাতের প্রসার ও এর সাথে পাল্লা দিয়ে পুঁজিবাদের সংকট চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শিল্পখাতের গুরুত্ব অনেক ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এসময় শিল্পখাতে উন্নয়নকাজ অনেক বিস্তৃত পরিসরে শুরু করে। এদেশের নীতিনির্ধারকগণ শিল্পখাতের বিপর্যয় চিহ্নিতকরণ থেকে শুরু করে আরাে নানা বিষয়ে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে কৃষিজাত পণ্যের অনর্থক দাম কমানােও মহামন্দার মত ঘটনাকে প্রণােদিত করতে পারে। তবে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের প্রভাবে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দুই দশক না পেরােতেই ধরা পড়ে ভার্সাই চুক্তির সারশূন্যতা আর লীগ অব নেশনসের অকর্মণ্য অবস্থান। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নতুন করে কেঁপে ওঠে আরেক দফা আক্রমণ আর হত্যাযজ্ঞের মর্মন্তুদ ঘটনায়। এরপর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫, দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে ৬ বছর ১ দিন। তারপর আবার শান্ত হয়ে আসে ইউরােপের বিভিন্ন রণাঙ্গন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা কিংবা আটলান্টিক অঞ্চলের পাশাপাশি আফ্রিকার নানা স্থান। সেই অক্ষশক্তি জার্মানের পক্ষে এবার যােগ দিয়েছে ভিন্ন মিত্র ইতালি, জাপান, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া আর বুলগেরিয়া। আর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মিত্রবাহিনীতে এবারের বড় আকর্ষণ রাশিয়া। রুশপন্থী ইতিহাসবিদদের ক্রমাগত পুঁজিবাদ ভৎর্সনা আর অতিরঞ্জিত বিবরণ থেকে বােঝা কঠিন হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসলে অক্ষশক্তি-মিত্রশক্তির মধ্যে হয়েছে, নাকি রুশ বনাম পুরাে বিশ্ব হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও অনুষ্ঠিত হয় অক্ষশক্তি আর মিত্রশক্তির মধ্যে। আর এবারে মিত্রশক্তির পুরােভাগে ছিল রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিল। ফলাফলটা শেষ পর্যন্ত এবারও বিপক্ষে গেছে অক্ষশক্তির। 

মিত্রশক্তির ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাশিয়ার নেতৃত্বে জোসেফ স্ট্যালিন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ট্রম্যান, যুক্তরাজ্যের উইনস্টন চার্চিল, চীনের চিয়াং কাইশেক, ফ্রি ফ্রান্স আন্দোলনের নেতা দ্য গল ফরাসিদের নেতৃত্বে রয়েছেন। থার্ড রাইখ সরকারের প্রধান, নাৎসি বাহিনীর পুরােধা, এসএস এবং এসএ ফোর্সের উদ্ভাবক, জার্মানির বহুল আলােচিতসমালােচিত নেতা অ্যাডলফ হিটলার ছিলেন অক্ষশক্তি তরফে নেতৃত্বের পুরােভাগে। ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি নেতা বেনিতাে মুসােলিনি এবং জাপানের সম্রাট হিরােহিতাে ও প্রধানমন্ত্রী তােজো ছিলেন স্ব স্ব বাহিনীর নেতৃত্বে। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পােল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে বলতে গেলে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়ে বিশ্বজনীন রূপ লাভ করে যখন জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে বসে। এরপর হিরােশিমা নাগাসাকিতে বর্বর আক্রোশে যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বােমা নিক্ষেপ ১৯৪৫ সালে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এরই মাঝে জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে একটি গােপন বাংকারে আত্মহননের মাধ্যমে জীবনের সব গ্লানি মুছতে চেষ্টা করেন অ্যাডলফ হিটলার। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ক্যালেন্ডারের পাতায় দুই দশকের বেশি সময় পার হয়নি; ঠিক ১৯৩৯ সালেই শুরু হয়ে যায়। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ। আর ফলাফল হিসেবে বিভিন্ন রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর প্রায় ১৬ লক্ষ সৈন্য নিহত হয়। এর বাইরে ৪৫ লাখের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।

আরো পড়ুন:  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছে একটি বিশ্বযুদ্ধ যা ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল

তথ্যসূত্র:

১. Charles Duhigg, “Depression, You Say? Check Those Safety Nets”, The New York Times, March 23, 2008.
২. Barry Eichengreen, Hall of Mirrors: The Great Depression, The Great Recession, and the Uses-and Misuses-of History (2014)
৩. মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, [Pdf]. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি ২০১৯. সানজিদা মুস্তাফিজ ও সুমা কর্মকার. সম্পা. পৃষ্ঠা ৭১; Retrieved from http://www.ebookbou.edu.bd/wp/OS/hsc4_2.php#hsc2855

Leave a Comment

error: Content is protected !!