ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে

ইতিহাসের মার্কসবাদী ব্যাখ্যাকে অনেক সময়ে ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা (ইংরেজি: Economic Interpretation of History) বলে অভিহিত করা হয়। বস্তুত মার্কসবাদের মূল সূত্র তিনটি বলে পরিচিত ১. বস্তুবাদ তথা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ২. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের ব্যাখ্যায় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ; ৩. সমাজের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ।

কার্ল মার্কস মানুষকেই ইতিহাসের নির্মাতা বলেছেন। তাঁর মতে মানুষই ইটিহাস তৈরি করে। কিন্তু যে-কোন ব্যক্তি-মানুষের ইচ্ছামাফিক নয়। মানুষ ইতিহাস বিধানকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দ্বারা দ্বান্দ্বিকভাবে জ্ঞাত হওয়ার মাধ্যমে ইতিহাস নির্মাতার ভূমিকা পালন করে। এর অর্থ, ব্যক্তি-নিরপেক্ষভাবে ইতিহাসের বিকাশের বিধান আছে। এই প্রসঙ্গে মার্কস বলেছিলেন, এ যাবৎকালের দর্শনের ইতিহাসে দেখা যায়, দার্শনিকগণ নানাভাবে জীবন ও সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন। যেন মানুষের ব্যাখ্যা করার অধিকতর কোনো ভূমিকা নেই। ‘আসলে প্রয়োজন এখন কেবল ব্যাখ্যার নয়, প্রয়োজন মাজকে পরিবর্তনের’। এমন কথা দ্বারা মার্কস ইতিহাসের বিকাশে ইতিহাসের বিধানের জ্ঞানে সমৃদ্ধ মানুষের সক্রিয় ভূমিকার উপর জোর প্রদান করতে চেয়েছেন।

মার্কসীয় সূত্রের সহজ ব্যাখ্যা এই যে, ১. বস্তু হচ্ছে মূল সত্তা; ২. বস্তুমাত্রই দ্বন্দ্বমূলক গতিসম্পন্ন; ৩. মানুষও বস্তুর দ্বন্দ্বমান বিকাশের প্রকাশ এবং মানুষের সামাজিক জীবনের ইতিহাসও হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দৃষ্টান্তস্বরূপ; ৪. মানুষের সমাজ-জীবনের মূল হচ্ছে মানুষের জীবন নির্বাহের জন্য কর্মকাণ্ড ততা তার অর্থনৈতিক কার্যাবলী।

অর্থনৈতিক কার্যাবলীর প্রধান হচ্ছে জীবিকা সংগ্রহের হাতিয়ার বা উপায় এবং এই হাতিয়ার বা উপায়সমূহের ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। এর একটিকে উৎপাদনের শক্তি এবং অপরটিকে উৎপাদনের সম্পর্ক বলে অভিহিত করা চলে। উৎপাদনের উপায় বা শক্তি এবং উৎপাদনের সম্পর্ক অপরিবর্তিত থাকে না। তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বমূলক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তার পরিবর্তিত হয় এবং আদিমকাল থেকে পরবর্তিত হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উপনীত হয়েছে। এই পরিবর্তন প্রবহমান।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্তার পর থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের পরে, সমাজ উৎপাদনের উপায়ের মালিক এবং অ-মালিক, এরূপ আর্থিক শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে। পুনরায় অর্থনৈতিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে যৌথ মালিকানা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সমাজ অর্থনৈতিকভাবে পরস্পর-বিরোধী দ্বন্দ্বমান শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং এই সমাজের ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। মানব সমাজের ইতিহাসের এরূপ ব্যাখ্যা ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা হিসাবে পরিচিত।

আরো পড়ুন:  ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৯৭-১৯৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!