অভিজাতবাদ বা সম্ভ্রান্তবাদ বা এলিটবাদ (ইংরেজি: Elitism) হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাত্ত্বিকদের মধ্যে আলোচিত একটি তত্ত্ব। ‘এলিট’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ। এ থেকে এলিটবাদকে শ্রেষ্ঠত্ববাদ কিংবা নয়া অভিজাতবাদ বলেও অভিহিত করা চলে। এই তত্ত্বের প্রধান প্রবর্তন হিসাবে ইতালির ভিলফ্রেডো পারেটো (১৮৪৩-১৯২৩) এবং গায়টানো মসকা পরিচিত। এ সমস্ত চিন্তাবিদ প্রধানত অযুক্তি এবং শক্তিবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী।
মানুষের চরিত্রের মধ্যে অযুক্তি এবং শক্তির প্রতি আকর্ষণমূলক প্রবণতার উপর অভিজাতবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জোর প্রদান করেন। এঁদের মতে প্রকৃতি মানুষকে সমাজ হিসাবে তৈরি করে নি। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নানা গুণের ভিত্তিতে ‘এলিট’ বা শ্রেষ্ঠ এবং ‘অ-এলিট’ বা ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ হিসাবে বিভক্ত। এবং সমাজের নেতৃত্ব কিংবা রাষ্ট্র শাসন উভয় ক্ষেত্রে চিরকাল যারা বিদ্যা, বুদ্ধি, চাতুর্য, কূট-কৌশল দৈহিক শক্তি ইত্যাদি গুণে শ্রেষ্ঠ তারা শাসন করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এরাই শাসন করবে। এই শ্রেষ্ঠ অংশ অবশ্যই সংখ্যালঘু। সংখ্যায় তারা অল্প। সেদিক থেকে অল্পরাই অধিকের উপর শাসন করে। এরূপ তত্ত্বের অপর এক সমর্থক রবার্ট মিশেল-এর মতে মানুষের জীবনে অল্পের শাসন হচ্ছে নিয়মের অমোঘ বিধান। তাঁর এরূপ অভিমত ‘আয়রন ল অব অলিগার্কী’ বা ‘কতিপয়ের লৌহ বিধান’ বলে পরিচিত।
প্রাচীনকালে প্লেটো-এ্যারিস্টটলও মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিগত গুণের উপর জোর দিয়ে মানুষের একাংশকে অভিজাত বলে অভিহিত করতেন। তার ভিত্তিতে ‘অভিজাততন্ত্র’ বলে এক প্রকার শাসন ব্যবস্থাকেও তাঁরা নির্দিষ্ট করেন। কিন্তু সে বর্তমান কালের এলিটবাদ বা শ্রেষ্ঠত্ববাদ কেবল মহৎ গুণের দ্বারা বিভক্ত করা অর্থহীন। চোর কিংবা ডাকাতের দক্ষতাও দক্ষতা, রাজনীতিকদের মধ্যে বাগ্মী বা কৌশলী রাজনীতিকের দক্ষতাও দক্ষতা। এদিক থেকে মানুষের যে-কোন পেশা বা গোষ্ঠীর মধ্যেই ‘শ্রেষ্ঠ’ ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ বলে ভাগ থাকে। এবং প্রত্যেকটি অংশের শ্রেষ্ঠরাই তথা অল্পরাই শাসন করে এবং অ-শ্রেষ্ঠ তথা সংখ্যাধিকেরা শাসিত হয়।
শাসনের ক্ষেত্রে এলিটদের দুই নামে অভিহিত করা চলে। যারা শাসকমণ্ডলীল অন্তর্গত তারা ‘পাওয়ার এলিট’ বা ‘শাসক-এলিট’ এবং যারা ‘শাসনের বাইরে অবস্থিত’ তারা ‘অ-শাসক’ বা ‘নন পাওয়ার এলিট’ বলে অভিহিত। এর ভিত্তিতে এদের তত্ত্বে ‘এলিট সঞ্চালন’ বা সারকুলেশন অব এলিট’ কথাটি এসেছে। শাসনের বাইরে এলিটরা শাসনের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কালক্রমে শাসক-এলিটরা অ-শাসক এলিট দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
সমাজকে শ্রেষ্ঠ, অ-শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যাল্প ও সংখ্যাধিকে বিভক্ত করার তত্ত্ব কোনো মৌলিক বা বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব নয়। এর মাধ্যমে মানুষের সমাজের সংকটের চরিত্র অনুধাবনে তেমন কোনো সুবিধা হয় না। বাহ্যত বিবরণমূলক এবং নীৎসের শক্তিবাদের সমর্থক এ তত্ত্বের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আশাবাদী চিন্তাকে নস্যাৎ করা। এর আক্রমণের প্রধান বিষয় হচ্ছে আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী চেতনা। মার্কসবাদী শ্রেণী বিশ্লেষণকে এ তত্ত্ব নাকচ করার চেষ্টা করেছে। এবং শক্তিবাদী এই তত্ত্বের অনুসরণেই বিংশ শতকে ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সামন্তবাদী ও একচেটিয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীসমূহ ফ্যাসিবাদ, নাজীবাদ ও সমরবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ঘটায়।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।