মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের বিষয়বস্তু প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের বিষয়বস্তু (ইংরেজি: Subject matter of Marxism-Leninism) হচ্ছে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সকল বিষয়। এই দর্শন হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ যা বিশ শতকের আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। কার্ল মার্কস এবং তাঁর সহযোগী ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস দ্বারা নির্মিত মার্কসবাদী দর্শনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তি নিহিত। ভি.আই. লেনিন প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং অনুশীলনে এই মতাদর্শের বৈশিষ্ট্য সংযুক্ত, এবং জে. ভি. স্তালিন কর্তৃক এই মতবাদের একীকরণ ও পরিচালনার মাধ্যমে ১৯২২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এটি সোভিয়েন ইউনিয়নে কার্যকরভাবে অনুশীলন করা হয়েছিল।[১]

উনিশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত, দর্শনকে দেখা হতো ‘সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান’ হিসেবে, অন্যান্য বিজ্ঞানের উপরে নিজের প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্তগুলি চাপিয়ে দেওয়ার স্বীকৃত অধিকার ছিলো তার। দর্শনের বিষয়বস্তু, অন্যান্য বিজ্ঞানের মধ্যে তার স্থান ও সমাজে তার ভূমিকা সম্পর্কে বহুযুগের বিতর্কের বিজ্ঞানসম্মত মীমাংসা ঘটিয়েছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস, যাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দর্শন।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দর্শনের বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। ‘প্রথমে, তার আওতায় ছিল পৃথিবী সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস যেমন বলেছিলেন, প্রাচীন দার্শনিকরা প্রকৃতিবিজ্ঞানীও, জায়মান বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। জ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ও তার বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্বন্ধে ক্রমে ক্রমে চেতনা ও বোধের ফলে উদ্ভব হয়েছিলো বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞানের: জ্যোতির্বিদ্যা, বলবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা ও অন্যান্য। সেই সঙ্গেই, এই বিজ্ঞানগুলি থেকে দর্শন পৃথক হয়ে গিয়েছিল, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানতত্ত্বে তার ক্রিয়া ও স্থান সুনির্দিষ্ট করে নিয়েছিল।[২]

দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠাতারা ধরে নিয়েছিলেন যে পারিপার্শ্বিক জগতের অবধারণা দর্শন ও অন্যান্য, নির্দিষ্ট বিজ্ঞান উভয়েরই উদ্দেশ্য। দর্শন ও নির্দিষ্ট, বিশেষ বিজ্ঞানগুলি, উভয়েই একই জগৎকে অধ্যয়ন করে। কিন্তু তাদের গবেষণার লক্ষ্যবস্তুতে একটি প্রভেদ আছে। সেই প্রভেদ এই ঘটনার দরুন যে পথিবীতে বিশ্বজনীন ও সুনির্দিষ্ট উভয়প্রকার নিয়মই আছে, যেগলি যুগপৎ ক্রিয়া করে একই ব্যাপার ও প্রক্রিয়াসমূহের অভ্যন্তরে। প্রকৃতির পৃথক পৃথক ক্ষেত্র ও সমাজ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নিয়মগুলো অধীত হয় নির্দিষ্ট, বিশেষ বিজ্ঞানগুলো দ্বারা, আর বিশ্বজনীন নিয়মগুলি হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের উপজীব্য বিষয়।[৩]

মার্কসবাদী লেনিনবাদী দর্শন হলো বিজ্ঞানসম্মত বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সাধারণ তত্ত্বগত ভিত্তি। বিশ্বের মানুষকে তা যোগায় প্রকৃতি, সমাজ ও চিন্তার নিয়মগুলি সম্পর্কে একটা জ্ঞান, পৃথিবীর ব্যবহারিক বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য যা প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে মাও সেতুং লিখেছেন,

“মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিনের তত্ত্ব সর্বত্রই প্রযোজ্য। তবে একে বেদবাক্য বলে মনে করা উচিত নয়, বরং কার্যকলাপের দিশারী বলে মনে করা উচিত। শুধু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কতকগুলো পদ বা শব্দসমষ্টি শেখা উচিত নয়, বরং তাকে বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসেবে শেখা উচিত। ব্যাপক বাস্তব জীবন ও বিপ্লবী অভিজ্ঞতাকে গবেষণা করার মাধ্যমে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন সাধারণ নিয়ম সম্পর্কে যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা উপলব্ধি করা উচিত, শুধু তাই নয়, বরং সমস্যার পর্যবেক্ষণ ও সমাধানে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ও পদ্ধতিকেও শেখা উচিত।[৪]

অর্থাৎ, মার্কসবাদী লেনিনবাদী দর্শন হলো এক বিজ্ঞান, যা দর্শনের বুনিয়াদি প্রশ্নের এক বস্তুবাদী উত্তরের ভিত্তিতে বস্তুগত পৃথিবীর বিকাশের সবচেয়ে সাধারণ, দ্বান্দ্বিক নিয়মগুলিকে, তার অবধারণা ও বৈপ্লবিক রপান্তরের উপায়কে প্রকাশ করে। তাই মার্কসবাদী লেনিনবাদী তত্ত্ব হচ্ছে জানা ও করার সম্পর্কের সমাধান। এই তত্ত্বকে অনুশীলনের মাধ্যমে জানতে হয় এবং জেনে পুনরায় অনুশীলনে যেতে হয়। মার্কসবাদের মতো মার্কসবাদ-লেনিনবাদও হচ্ছে বাস্তব ক্রিয়াকাণ্ডের দর্শন। এই প্রসঙ্গে মাও সেতুং লিখেছেন,

“যদি একটি নির্ভুল তত্ত্ব থাকে, কিন্তু যদি সেটাকে শুধু বকবকই করা হয়, সুউচ্চ মন্দির শীর্ষে রাখা হয় এবং কাজে ব্যবহার না করা হয়, তাহলে সেই তত্ত্বটি যত ভালই হোক না কেন, তার কোনো তাৎপর্যই থাকে না।”[৫]

মার্কসবাদী লেনিনবাদী দর্শনের অন্যতম বিষয়বস্তু ও সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিশেষ শাখাগুলোর সঙ্গে ও সামাজিক কর্ম প্রয়োগের সঙ্গে তার আন্তঃসম্পর্ক। এক দিকে, তা বিশেষ বিজ্ঞানগুলিকে ও সামাজিক কর্ম প্রয়োগকে পারিপার্শ্বিক জগতের অস্তিত্ত্বের মূল নীতিসমূহ ও বিকাশের মূল নিয়মগুলো সম্বন্ধে জ্ঞান যোগায়। সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও মানুষদের ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপকে তা চালিত করে একমাত্র সঠিক পথটিতে। অন্য দিকে, তা সমৃদ্ধ ও মত-নির্দিষ্ট হয় বিশেষ বিজ্ঞানগুলির উপাত্ত ও সামাজিক কর্ম প্রয়োগ দিয়ে। বিরাট বিরাট বৈজ্ঞানিক আবিস্কার আর প্রগাঢ় সামাজিক রূপান্তরগুলির এই যুগে মার্কসবাদী লেনিনবাদী দার্শনিক প্রশিক্ষণ ব্যতীত সুসংগতভাবে বৈজ্ঞানিক ও বৈপ্লবিক অবস্থান গ্রহণ করা অসম্ভব। সেই জন্যই মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টিগুলি শ্রমজীবী জনগণের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক শিক্ষার দিকে এবং তাদের কর্মীদের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তালিমের দিকে এতো মনোযোগ নিয়োজিত করে।[৬] এই প্রসঙ্গে মাও সেতুংয়ের উল্লেখ করছেন যে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ‘তত্ত্বকে গভীরভাবে আয়ত্ত করা ও তা প্রয়োগ করা উচিত, গভীরভাবে আয়ত্ত করার একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে তা প্রয়োগ করা। … … যত বেশি, ব্যাপক ও গভীরভাবে আপনি তা করবেন, আপনার সাফল্য ততই বৃহত্তর হয়ে উঠবে।’[৭]

বিশ্ববীক্ষাগত ও পদ্ধতিতত্ত্বগত প্রশিক্ষণ নির্ভর করে মার্কসবাদ লেনিনবাদ ও তার তত্ত্বগত ভিত্তি অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অধ্যয়নের উপরে। পৃথিবীর বিকাশ সংক্রান্ত নিয়ামক নিয়মগুলো ও সমাজবিকাশের নিয়মগুলো সম্বন্ধে জ্ঞান উদ্ভূত সমস্যাগুলিকে শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষকসমাজের স্বার্থে, সমস্ত শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থে সমাধান করার কাজে সাফল্যের এক নিশ্চিতি। মাও সেতুং এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন,

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব ও পদ্ধতি দিয়ে চারদিকের পরিবেশকে সুব্যবস্থিতভাবে ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করা উচিত। কেবলমাত্র উৎসাহের উপর নির্ভর করেই কাজ করা চলবে না বরং স্তালিন যেমন বলেন: বিপ্লবী মনোবলকে বাস্তবনিষ্ঠার সংগে মিলিয়ে নিতে হবে।[৮]

শুধু উৎসাহ নিয়ে কাজ করলে সাফল্য আসবে না, বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের পদ্ধতি ছাড়া চলবে না। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের বিষয়বস্তু এই ত্তত্বকে বোঝা ও আয়ত্ত করা, বাস্তব জীবনের কর্মকাণ্ডে প্রয়োগ করার মাধ্যমে প্রগতির পক্ষে লড়াই জারি রাখতে নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, “মার্কসবাদী লেনিনবাদী দর্শনের বিষয়বস্তু প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সব বিষয়” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/ideology/leninism/features-of-marxism-leninism/
২. ভাসিলি ক্রাপিভিন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কী; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৯; পৃষ্ঠা ২৬-২৯
৩. ভাসিলি ক্রাপিভিন, পূর্বোক্ত ৪. মাও সেতুং, “জাতীয় যুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির স্থান” অক্টোবর , ১৯৩৮, সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা ৩৫৩-৩৫৪
৫. মাও সেতুং, অনুশীলন সম্পর্কে, জুলাই ১৯৩৭, সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা ৩৫৩-৩৫৪
৬. ভাসিলি ক্রাপিভিন, পূর্বোক্ত
৭. মাও সেতুং, পার্টির রীতির শুদ্ধিকরণ, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২, সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা ৩৫৪-৩৫৫
৮. মাও সেতুং, “আমাদের শিক্ষার সংস্কার করুন” মে ১৯৪১, সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা ২৬৬

Leave a Comment

error: Content is protected !!