সংক্ষিপ্ত মন্তব্য
আমার মনে হয়, “অবকাশ যাপনে কমরেড লেনিন” নিয়ে এখন লিখতে যাওয়াটা যথাযোগ্য হবে না, যখন অবকাশ-কাল শেষ হয়ে আসছে এবং শীঘ্রই কমরেড লেনিন কাজে ফিরে আসবেন। তাছাড়া, আমার অনুভূতিগুলো এত বেশি আর এত ভারি যে, ‘প্রাভদা’র সম্পাদকমণ্ডলী যেভাবে অনুরোধ করেছেন তেমনি একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে সেগুলো সম্পর্কে লেখাটা নিতান্ত সুবিধাজনক নয়। যাই হোক, আমাকে লিখতেই হচ্ছে, কারণ সম্পাদকমণ্ডলী এ ব্যাপারে নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছেন।
রণাঙ্গণে এমন সমস্ত ঝানু যোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ আমার হয়েছিল যারা একটানা কয়েকদিন অব্যাহতভাবে লড়াই করার পর, নিদ্রা ও বিশ্রামবিহীন অবস্থায়, যুদ্ধের সম্মুখ সারি থেকে ফিরে আসতেন, দেখতে যাঁদেরকে অশরীরা আত্মার মতো মনে হতো এবং যাঁরা অসাড় হয়ে নিদ্রায় ঢলে পড়তেন, কিন্তু “এক আধ দিন নিদ্রিত থাকার” পর, তারা নতুন তেজ নিয়ে জেগে উঠতেন এবং নতুন লড়াইয়ের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন, যা ছাড়া তারা “বাঁচতেই পারতেন না”। ছয় সপ্তাহ ধরে তাঁকে দেখতে না পেয়ে, জুলাই মাসে যখন আমি কমরেড লেনিনের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম, তখন ঠিক এই অনুভূতির ছাপই তিনি আমার উপর ফেললেন — অর্থাৎ, একজন ঝানু যোদ্ধা যিনি একটানা ও কষ্টকর লড়াইয়ের পর কিছুটা বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন, এবং যিনি বিশ্রামের বদৌলতে নতুন তেজশক্তি অর্জন করেছেন। তাঁকে সজীব ও রোগমুক্ত দেখাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু অতি-পরিশ্রম ও অবসান্নতার চিহ্ন তখনও তাঁর মধ্যে বিদ্যমান।
বিদ্রুপ ছলে কমরেড লেনিন মন্তব্য করলেন, “সংবাদপত্র পাঠের অনুমতি আমার নেই, আর রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলতেও পারবো না । টেবিলের উপর পড়ে থাকা প্রতিটি কাগজের টুকরাই আমি সযত্নে এড়িয়ে চলি, পাছে-না তা আবার সংবাদপত্র হয়ে পড়ে এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের দিকে তড়িত করে”।
আমি প্রাণ খুলে হাসলাম আর শৃঙ্খলার প্রতি তাঁর আনুগত্যের জন্যে আকাশচুম্বী প্রশংসা করলাম। আমরা হাসিঠাট্টা করে ডাক্তারদের অপদস্থ করতে গেলাম, যারা একথা বুঝতে পারে না যে, পেশাদার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যখন একত্রে মিলিত হন তখন তারা রাজনীতি নিয়ে আলাপ না করে পারেন না।
কমরেড লেনিনের মধ্যে যা একজনকে বিমুগ্ধ করে দেয় তা হলো সংবাদাদি জানার জন্যে তাঁর আকুল আকাংখা এবং কাজের জন্যে তাঁর ব্যাকুলতা, অদম্য ব্যাকুলতা। একথা পরিষ্কার যে তিনি মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন। সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারীদের বিচার অনুষ্ঠান, জেনোয়া ও হ্যাগের খবর, ফসলের সম্ভাবনা, শিল্প ও আর্থিক পরিস্থিতি — এই সমস্ত প্রশ্নই একের পর এক দ্রুত আসতে লাগলো। নিজের মতামত ব্যক্ত করার জন্যে তিনি অস্থিরতা প্রকাশ করলেন না, অভিযোগ করলেন যে তিনি ঘটনাবলীর পেছনে পড়ে থাকছেন; অধিকাংশ সময়ই তিনি প্রশ্নের পর প্রশ্নই করে গেলেন এবং নীরবে নোট নিলেন। ফসলের সম্ভাবনা ভালো — একথা জেনে তিনি খুবই আনন্দিত হয়ে ওঠলেন।
মাস খানেক পর সম্পূর্ণ এক ভিন্ন চিত্রই আমি দেখতে পেলাম। এবার স্তুপীকৃত বই আর সংবাদপত্রের মধ্যে ডুবে আছেন কমরেড লেনিন (পড়াশোনার এবং প্রাণ ভরে রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলার অনুমতি তাঁকে দেয়া হয়েছে)। অবসন্নতা বা অতি পরিশ্রমের কোনো চিহ্নই আর নেই। কাজের জন্যে সেই অসহায় ব্যাকুলতার কোনো লক্ষণও আর নেই – তাঁকে আর দেখতে মৃতপ্রায় লাগছিল না। প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি মাত্রায় ফিরে এসেছে। সেই আমাদের প্রবীণ লেনিন, চোখগুলোতে অনুসন্ধানী দ্যুতি আর যার সাথে কথা বলছেন তাঁর দিকে শ্যান দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন … …।
আর এবারে আমাদের কথাবার্তাও হলো আরো জীবন্ত চরিত্রের।
অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি … … ফসল … … শিল্পের হাল-হকিকৎ … … রুবলের বিনিময়-হার … … বাজেট … …
“পরিস্থিতিটা বিপত্তিময়। কিন্তু কঠিন সময়টা কাটিয়ে ওঠা গেছে। ফসল লাভের পর অবস্থাটা মৌলিকভাবে বদলে যাবে। শিল্প ও আর্থিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর পরে উন্নতি ঘটবেই। এখন যে-জিনিসটি করতে হবে তা হলো আমাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ ও শিল্প উদ্যোগগুলোতে খরচ কমিয়ে এবং সেগুলোর উন্নতি বিধান করে অপ্রয়োজনীয় খরচপত্র থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করা। এ ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই বিশেষভাবে দৃঢ় হতে হবে, আর আমরা শক্ত করে পেটি কষে পথ করে নেবই, অত্যন্ত সুনিশ্চিতভাবেই করবো।”
বৈদেশিক বিষয়াবলী … … আঁতাত … … ফ্রান্সের আচরণ … … ব্রিটেন ও জার্মানী … … আমেরিকার ভূমিকা
“তারা হলো অর্থগৃধ্নু, আর তারা একে অপরকে ভীষণ ঘৃণা করে। অধিকন্তু তারা বিবাদমান। আমাদের তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আমাদের রয়েছে নিশ্চিত পথ: আপোষের আমরা বিরোধী। আমাদের অবশ্যই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে এবং নিজেদের পথ করে নিতে হবে, আর কোন তোয়াজ-তোষণ বা ভয়-ভীতির সামনে অবশ্যই মাথা নত করা চলবে না।”
সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারি ও মেনশেভিকরা, আর সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের উন্মত্ত প্রচারণা … … ”।
“হ্যাঁ, সোভিয়েত রাশিয়াকে মর্যাদাহীন করে তোলাটা তারা তাদের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করেছে। সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের সংগ্রামকে তারা সহায়তা প্রদান করছে। তাঁরা পুঁজিবাদের পাকে আটকা পড়ে গেছে এবং গভীর খাদে তলিয়ে যাচ্ছে। পাঁক থেকে উঠার জন্যে হাস্যকর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা তারা করুক। শ্রমিকশ্রেণীৱ দিক থেকে বলতে গেলে বহু আগেই তাদের মৃত্যু ঘটেছে।”
শ্বেতরক্ষীদের সংবাদপত্র … … দেশান্তরী লোকজন … … লেনিনের মৃত্যু সম্পর্কে অবিশ্বাস্য গাঁজাখুরি গল্প, পূর্ণ বয়ান সহকারে … …
কমরেড লেনিন মুচকি হাসলেন এবং বললেন, : “মিথ্যা বলে কোনো সান্ত্বনা যদি তারা পেয়ে থাকে তাহলে সেটা তাদের পেতে দিন; মৃত্যুপথযাত্রীকে তার শেষ সান্ত্বনা থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়!”
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯২২
বি. দ্র.: লেখাটি প্রথম প্রাভদার ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয়। এখানে সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স, ঢাকা কর্তৃক এপ্রিল ২০০৯ সালে প্রকাশিত লেনিন ও লেনিনবাদ প্রসঙ্গে পুস্তিকার ১২-১৩ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে।
জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন বা যোসেফ স্তালিন বা জোসেফ স্ট্যালিন (১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৯- ৫ মার্চ ১৯৫৩) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মানে এবং একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দীর্ঘতম সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ তথা বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম যোসেফ ভিসারিওনোভিচ সোসো, স্তালিন নামটি তিনি ১৯১০ সালে ‘লৌহমানব’ অর্থে ধারণ করেন। তাঁকে মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা ও জনগণের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়।