প্রগতিশীলবাদ (ইংরেজি Progressivism) হচ্ছে সমাজবিপ্লবে অগ্রণী শ্রেণির সেই মতবাদ যাতে সমাজ বিপ্লবের বা সমাজ সংস্কারের পক্ষে সমর্থন বা পক্ষাবলম্বন করা হয়। প্রগতি হচ্ছে পরিশোধিত, উন্নতিকৃত অথবা কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হওয়া। অন্য কথায়, প্রগতিশীলবাদের প্রেক্ষাপটে, প্রগতি হচ্ছে এমন ধারণা যেটির ফলে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সামাজিক সংগঠনের অগ্রগতির ফলস্বরূপ বিকশিত মানব অবস্থা পাওয়া যায়; এবং মানুষের এই উন্নত অবস্থা পাওয়া যেতে পারে মানুষের প্রত্যক্ষ ক্রিয়ার ফলে, বা সামাজিক উদ্যোগ বা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, বা সমাজ-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রাকৃতিক অংশের মাধ্যমে।
প্রগতিশীলতা বা প্রগতিশীলবাদ শব্দটা ইংরেজি Progressivism এর বাংলা। প্রগতিশীল শব্দের দ্বারা আমরা এমন একটি শ্রেণিকে বুঝি যে শ্রেণি অর্থনৈতিক লড়াইয়ে অতীতের সমাজকে ভেঙে নতুন সমাজ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সে হিসেবে পুঁজিবাদি সমাজের অভ্যন্তরে অবস্থান করে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করার কাণ্ডারিগণই কেবল প্রগতিশীল বলে অভিহিত হতে পারেন।
সমাজবিপ্লবের সাথে সম্পর্কহীন করে প্রগতিশীলবাদকে বুঝলে আমরা বারবার ভুল জায়গাতে প্রগতিশীলতাকে খুঁজতে পারি। এর ফলে আমরা প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলের পার্থক্যটিকে ঠিকঠাক বুঝতে পারবো না। এক্ষেত্রে সমাজ বিপ্লবের সংজ্ঞায় আমরা পাই,
সমাজবিপ্লব হলো সেকেলে সমাজব্যবস্থা থেকে প্রগতিশীল শক্তিগুলোর মাধ্যমে সাধিত বিকাশের একটি গুণগত, নতুন ও উচ্চতর পর্যায়ের দিকে সমাজের অগ্রগতি, একটি নতুন ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থায় উত্তরণ।[১]
বিশ শতকে প্রগতিশীলবাদের সাথে জড়িয়ে যায় সমাজতন্ত্র অভিমুখী সকল আন্দোলন; কেননা সমাজতন্ত্রই কেবল সামাজিক সম্পর্কগুলোকে অবিরাম উন্নত করে চলে। সমাজতন্ত্রই কেবল দেখায় গোটা জীবনধারার বাস্তব মানবিকতা। সমাজতন্ত্র যুদ্ধ ও অস্ত্র শিল্প, প্রতিক্রিয়া ও বলপ্রয়োগের ভাবাদর্শ ও নীতি এবং সমস্ত রকমের মানববিদ্বেষে পাকাপোক্ত প্রতিবন্ধকতা স্থাপনের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে সামাজিক প্রগতিতে।
সমাজবিপ্লবের সাথে সম্পর্কহীন করে প্রগতিশীলতাকে বুঝেছেন বুর্জোয়া মানবতাবাদীরা, বুলিবাগিশ আধুনিক অধ্যাপকেরা, যান্ত্রিক বস্তুবাদীরা এবং সমাজ-গণতন্ত্রী, সংস্কারপন্থী গণতন্ত্রী ও আমূল সংস্কারপন্থী গণতন্ত্রীরা। যেমন যান্ত্রিক বস্তুবাদী হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন,
প্রগতিশীলতা হচ্ছে চেতনার বিবর্তন বা গতিশীলতা। এর ক্রিয়ায় পুরোনো হয়ে ওঠে একদিন যা ছিল অভাবিত অভিনব, বাতিল হয়ে যায় অনেক পূজনীয় বিশ্বাস, পরিত্যক্ত হয় এমন অনেক চিন্তা, যা চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল তীব্রভাবে। কোনো কিছুই চিরপ্রগতিশীল নয়।[২]
সাম্রাজ্যবাদবিরোধি মহান বিপ্লবী ভগৎ সিং লিখেছেন,
যে মানুষ প্রগতির পক্ষে তাকে পুরোনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যথেষ্ট যুক্তিতর্ক ও বিচার-বিবেচনার পর যদি কেউ কোনো তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তার বিশ্বাসকে স্বাগত জানাতে হয়। তার চিন্তাভাবনা ভুল বা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কিন্তু তা শোধরানোর সুযোগ আছে, কারণ সে পরিচালিত হয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা, অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নয়। বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক, তা মস্তিষ্ককে অকোজো করে দেয়, মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে তোলে।[৩]
মাও সেতুং প্রগতিশীল বিষয়গুলোর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে লিখেছেন,
স্মরণাতীত কাল থেকে কোনো প্রগতিই প্রথমে সহজে গৃহীত হয়নি এবং প্রতিটি প্রগতিশীলতাকেই ব্যতিক্রমহীনভাবে দুর্ব্যবহারের লক্ষ্য হতে হয়েছে। মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রথম থেকেই গালাগাল শুনতে হয়েছে। এখন থেকে ১০,০০০ বছর পরেও, প্রগতিশীল বিষয়গুলোকে তার সূত্রপাতে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে।[৪]
প্রগতিশীলতার সাথে কল্পনার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলবার্ট আইন্সটাইন লিখেছেন,
কল্পনা জ্ঞানের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জ্ঞান সীমিত, পক্ষান্তরে কল্পনা বেষ্টন করে সমগ্র পৃথিবীকে, উদ্দীপিত করে প্রগতিকে, জন্ম দেয় ক্রমবিকাশের। যথাযথভাবে বললে, তা হল বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এক বাস্তব বিষয়।[৫]
বিশ শতকে সামাজিক প্রগতির ধারা নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলো সমাজতন্ত্র অভিমুখী সংগ্রাম, উপনিবেশবিরোধী বিপ্লব, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই, বহু রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম এবং অনেক নতুন জাতির উদ্ভবের সংগে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সাথে পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র আর সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধিতার মাধ্যমে অতীত দাসত্বকে কাটিয়ে ওঠার লড়াইয়ের নাম হচ্ছে প্রগতিশীল লড়াই। এই লড়াইয়ের নানা রূপ প্রকাশিত হয় নানাভাবে। সেগুলোর কয়েকটি হচ্ছে, শ্রমিক কৃষকের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম, প্রলাতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম, নয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সাম্রাজবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশসমূহের স্বাধীনতার সংগ্রাম, জনগণের বৈপ্লবিক সংগ্রাম ইত্যাদি।
সামাজিক প্রগতি আত্মপ্রকাশ করতে পারে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশে, সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও অস্ত্র শিল্পবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্ফুরণে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর সর্বগ্রাসি একচেটিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই কেবল একটি সমাজকে প্রগতিশীল করতে পারে।
শোষক দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদী সমাজের প্রগতিকে মার্কস তুলনা করেছেন সেই ‘বীভৎস ম্লেচ্ছ দেবতার সংগে যে নিহতের করোটিতে ছাড়া অমৃত পান করতে অনিচ্ছুক’[৬]। মার্কস তাই পথ দেখান প্রগতিকে সেই পর্যন্ত লড়তে হবে যতক্ষণ না গোটা দুনিয়ায় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১. আ. স্রেতসোভা; বিপ্লব কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৯; পৃষ্ঠা ১২।
২. হুমায়ুন আজাদ; কুমার চক্রবর্তীর গ্রন্থ মৃতদের সমান অভিজ্ঞতে উদ্ধৃত, পলল প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯; পৃষ্ঠা-৪১।
৩. ভগৎ সিং, কেন আমি নাস্তিক।
৪. মাও সেতুং, প্রদেশ, মিউনিসিপ্যাল ও স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের পার্টি কমিটিগুলোর সেক্রেটারিদের এক সম্মেলনে আলোচনা (১৯৫৭)। মাও সেতুং-এর শেষ জীবনের উদ্ধৃতি।
৫. Albert Einstein, Cosmic Religion, Covici Friede Publishers, New York, 1971, P. 97.
৬. কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচনাবলী, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা-২০০।
রচনাকালঃ আগস্ট ২৮, ২০১৪
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।