সমাজতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ

পুঁজিবাদের উদ্ভব হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এটাকে সচেতনভাবে পরিকল্পনা অনুসারে গড়ে তোলা হয় না। পুঁজিবাদের আগের দুটি শোষণমূলক ব্যবস্থা দাস সমাজ এবং সামন্তবাদও দেখা দিয়েছিলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সমাজতন্ত্রের বেলায় ব্যাপারটা পুঁজিবাদ এবং তার আগের বিভিন্ন রূপের সমাজ থেকে আলাদা। সমাজতন্ত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখা দিতে পারে না। মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টির নেতৃত্বে প্রলেতারিয়েত দ্বারা পরিচালিত সচেতন ক্রিয়াকলাপে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা হয়।

পুঁজিবাদের বিলুপ্তির পরে যে সমাজ গড়ে উঠবে তার নাম সাম্যবাদী সমাজ। এই সাম্যবাদী সমাজের আছে দুটি স্তর। প্রথম স্তরের নাম সমাজতন্ত্র যার আরেক কেতাবি নাম উত্তরণ পর্ব। দ্বিতীয় স্তরের নাম সাম্যবাদ বা কমিউনিজম। সাম্যবাদের নিম্নতম স্তর সমাজতন্ত্রের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিরাজমান।

১. সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক মালিকানার দুটি প্রধান ধরনকে নিয়ে। এই প্রধান ধরন দুটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় (সর্বজনীন) এবং যৌথখামারী-সমবায়ী মালিকানা। সমাজতন্ত্র তেমন সমাজ যার পতাকায় লেখা থাকে: ‘সবকিছু মানুষের জন্য, সবকিছু মানুষের কল্যাণার্থে’। 

২. সমাজতন্ত্রের বৈষয়িক প্রযুক্তি বুনিয়াদের কল্যাণে এমনসব উৎপাদনী শক্তির বিকাশ ঘটানো যায়, যেগুলো সমাজতান্ত্রিক সমাজের মূলনীতি, প্রত্যেকের কাছ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী আর প্রত্যেককে শ্রম অনুযায়ী, বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়। সমাজতন্ত্রে শ্রম আর নেহাত পেট চালাবার জন্য নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই, তা পরিণত হয় সামাজিক কর্মে, খোদ মানুষকেই যা নির্মাণ ও লালিত করে। সমাজতন্ত্রের মূলনীতির ভিত্তিতে সবার জন্য শ্রমের ও পারিশ্রমিকের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়। উৎপাদনী শক্তির গতিময় ও পরিকল্পিত বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয় এই সমাজে; বৈজ্ঞানিক ও টেকনিকাল প্রগতিতে বেকারি দেখা যায় না, সমগ্র জনগণের স্বচ্ছলতা অবিরাম বাড়তে থাকে।

৩. সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপায় জনগণের হাতে থাকে। মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণের, সামাজিক পীড়নের, সুবিধাভোগী অল্পাংশের ক্ষমতা, লক্ষ লক্ষ লোকের নিঃস্বতা ও নিরক্ষরতার অবসান হয়েছে চিরকালের জন্য। যদিও সমাজতান্ত্রিক সমাজের উত্তরণ পর্বে হাজির থাকে পণ্য উৎপাদন ও আর্থিক সম্পর্ক। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি মুনফার কোনো সুযোগ থাকে না।

৪. সমাজতন্ত্রে থাকে দুটি মিত্র শ্রেণি: প্রলেতারিয়েত শ্রমিক শ্রেণি ও সমবায়ী কৃষককুল; আর তাদের সংগে এক সামাজিক স্তর মনীষী বা Intellectual সম্প্রদায়। তাদের মধ্যকার অটুট বন্ধনই সৃষ্টি করে সমাজের সামাজিক বুনিয়াদ। প্রলেতারিয়েত, শ্রমিক শ্রেণি ও সমবায়ী কৃষককুল আর মনীষীদের অটুট মৈত্রী এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, নারী ও পুরুষের অধিকার সমান, কার্যক্ষেত্রে তার রূপায়ণ গ্যারান্টিকৃত। এই সমাজে নবীনদের জন্য নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যৎ উন্মুক্ত, প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা গ্যারান্টিকৃত।

৫. সমাজতান্ত্রিক সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল উপাদানগুলি হলও রাষ্ট্র, সমাজের নেতৃজনিত ও চালিকা শক্তি মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টি, নানা সামাজিক সংগঠন ও মেহনতি কর্মীদল।

৬. সমাজতান্ত্রিক সমাজের আত্মিক জীবনের বৈশিষ্ট্য হলও সামাজিক চেতনায় মার্কসীয় লেনিনীয় ভাবাদর্শের প্রাধান্য, সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সব মেহনতি ও উঠতি প্রজন্মের কমিউনিস্ট শিক্ষা, নতুন মানুষ গড়া। এ সমাজে দেখা দেয় ও বেড়ে ওঠে কমরেডসুলভ পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক, সামাজিক জীবনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আত্মিক ক্ষেত্রে জেগে উঠে কোটি কোটি মেহনতি জনগণের সৃজনী সক্রিয়তা। সামাজিক ন্যায় ও যৌথতার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক জীবনযাত্রা শ্রমজীবী মানুষকে দেয় ভবিষ্যতে আস্থা। নতুন সামাজিক সম্পর্কের স্রষ্টা প্রলেতারিয়েত নিজের ভাগ্যের নির্মাতারূপে নিজেকে নৈতিক ও আত্মগত দিক থেকে উন্নত করে। এই সমাজে জ্ঞানের সমস্ত উৎস জনগণের জন্য উন্মুক্ত। বিশ্ব সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ সবকিছু নিয়ে গড়ে উঠেছে অগ্রণী সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি।

আরো পড়ুন:  বিকেলের কূলে

৭. সমাজতন্ত্রে বেতন ও মজুরির অনুপাত সমান অর্থাৎ একজন কর্মকর্তা বা পদাধিকারীর বেতন একজন সুযোগ্য দক্ষ শ্রমিকের মজুরির সমান হবে। বেতন ও মজুরির সমান হবার বিষয়টি পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে যাবার সেতুস্বরূপ। সমস্ত পদাধিকারীর বেতনকে মজুরের সাধারণ বেতনে নামানো এবং পুরাতন বেতনকাঠামোর স্তরের বিলুপ্তি ঘটানো সমাজতান্ত্রিক সমাজের কাজ।

৮. সমাজতান্ত্রিক সমাজে শহর ও গ্রামের সামাজিক পার্থক্য ক্রমশ দূরীভূত হবে। ছোট পল্লী ও গ্রামগুলো সুপরিকল্পিত ও সুব্যবস্থাযুক্ত উপনগরীতে রূপায়িত হবে। গ্রামীণ এলাকাগুলতে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক পাঠাগার, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক ব্যবস্থা, শিশুসদন, হোটেল, রেস্তোরা, থিয়েটার হল, সাধারণ ভোজনালয় প্রভৃতি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর জাল বিস্তার করা হবে। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাকে এমনভাবে বিস্তৃত করা হবে যাতে নাগরিকগণ শহরের সব সুবিধা গ্রামেও পেতে পারেন। গ্রামের শ্রমজীবী জনসাধারণ আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবহার করতে শিখবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা শহরের শ্রমিকদের পর্যায়ে উন্নীত হবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির যেসব সুযোগ সুবিধা আগে কেবল শহরেই পাওয়া সম্ভব ছিলো তা গ্রামেও পাওয়া যাবে।

৯. সমাজতন্ত্র মানসিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দুর করে। সব বৈরী শ্রেণিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় উপস্থিত মানসিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যকার বৈপরীত্য অতিক্রম করার প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটায় সমাজতন্ত্র। শ্রেণিভিত্তিক সমাজগুলোতে মানসিক শ্রম সর্বদা ছিল শোষক শ্রেণিগুলোর একচেটিয়া ব্যাপার এবং তা কাজ করত শোষিত শ্রেণিগুলোর উপর চাপান কায়িক শ্রম শোষণের হাতিয়াররূপে। সমাজতন্ত্রে মানসিক শ্রম কোনো শ্রেণি বা সামাজিক স্তরের বিশেষ সুযোগরূপে থাকে না এবং সব মেহনতির পক্ষে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত মালিকানা ও গোটা শোষণব্যবস্থা উৎখাতের ফলে কায়িক ও মানসিক শ্রমের লোকদের মধ্যকার পরস্পর বিরোধিতাও দুর হয়। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা পরিচালিত কায়িক ও মানসিক শ্রমের লোকদের ক্রিয়াকলাপ এক অখণ্ড মেহনতি প্রক্রিয়ার লক্ষ্যনিষ্ঠ সৃজনশীল আকার ধারণ করে।  

১০. সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শোষণের কোনো সুযোগ থাকে না এবং প্রত্যেকেই সমান সমান সুবিধা ভোগ করে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মানুষের সকল মৌলিক প্রয়োজনীয়তা যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। সমাজতন্ত্র হচ্ছে এমন সমাজ যেখানে শ্রেণিশোষণ বিলুপ্ত। এই সমাজের প্রধান কাজ হচ্ছে মেহনতি শ্রেণি ও সামাজিক গ্রুপের মধ্যে পার্থক্যের অবসান এবং সাম্যবাদে উত্তরণের পরিস্থিতি গঠন ও বিকাশ। তাই, উত্তরণকালীন পর্যায়ে সমাজতন্ত্র সম্পূর্ণ সামাজিক সমতা সুনিশ্চিত করতে পারে না। সমাজের শ্রেণি বিভাজন বিলুপ্তির ফলে সমাজের সব লোকের সম্পূর্ণ সামাজিক সমতা বাস্তব রূপ লাভ করবে সাম্যবাদী সমাজে।

১১. সমাজতন্ত্রের পর্বে মানুষের চেতনায় ও আচরণে পুঁজিবাদের নানা জের অবশিষ্ট থাকে, কেননা ব্যক্তিগত মালিকানার মনোভাব থেকে সমাজ এখনও পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। তবে স্বাধীনতা, মানবিক অধিকার ব্যক্তির মর্যাদা বাস্তবে প্রতিভাত এবং অধিকার ও কর্তব্যের ঐক্য সুনিশ্চিত হয়। সমাজতন্ত্রে প্রত্যেকের ও সকলের জন্য নৈতিকতার একই নিয়ম ও আদর্শ, একই শৃঙ্খলা বলবত, ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য ক্রমেই অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে উঠে।  

১২. সমাজতান্ত্রিক সমাজে জাতিগত অসাম্য দূরীভূত, সমস্ত জাতি ও জাতিসত্তার সমতা, মৈত্রী, সৌভ্রাত্র আইনত ও কার্যত প্রতিষ্ঠিত। এ সমাজে পরাধীন জাতি নেই, নেই কোনো জাতিগত নিপীড়ন, জাতি বা গাত্রবর্ণের প্রভেদের দরুন কাউকে বড় বা ছোট বিবেচনা করা হয় না। প্রত্যেক জাতিকে নিজস্ব অর্থনৈতিক সম্পদ এবং কৃষ্টি ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যের বিকাশে সাহায্য করা হয়। মানুষ কর্তৃক মানুষকে, জাতি কর্তৃক জাতিকে শোষণ থেকে মুক্ত সমাজ হচ্ছে সমাজতন্ত্রের একটি মূলনীতি। এই মূলনীতির সাথে সরাসরি জড়িত নতুন ধরনের সম্পর্কের আরেকটি মূলনীতি আর সেই মূলনীতিটি হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একত্র সংগ্রামে, সমাজতন্ত্রের সুকৃতি রক্ষায় সমাজতন্ত্র অভিমুখী পার্টি ও দেশগুলোর পারস্পরিক সাহায্য।

আরো পড়ুন:  সমবায় প্রসঙ্গে

১৩. সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সাস্থ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি সকল খাতে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উন্নয়ন করা হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা দেশ বা সমাজের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয় বিধায় অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদনজনিত সঙ্কট দেখা দেয় না। অর্থাৎ সামাজিক কল্যাণ সাধনই এই এই অর্থ ব্যবস্থার মুল উদ্দ্যেশ্য। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন, বন্টন, বিনিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ থাকে। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা মাফিক সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাই এই অর্থব্যবস্থায় বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দ্রব্যের মূল্য পুঁজিবাদের ন্যায় চাহিদা ও যোগানের ঘাত প্রতিঘাত অনুযায়ী আপনা আপনি নির্ধারিত হয় না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষই দ্রব্যসামগ্রীর দাম নির্ধারন করে থাকে।

১৪. সমাজতান্ত্রিক সমাজ সুপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষপাতী। রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনসাধারণের ইচ্ছার সমন্বয়ের ভিত্তিতেই পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত কাজকর্ম চলবে। বাস্তব অবস্থা অনুসারে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে পারিবারিক বৈষম্য, নিপীড়ন ও নারী পুরুষের বৈষম্য সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিলুপ্ত হবে। মাতা বা সন্তান শোষণের সকল প্রক্রিয়া থেকে এই সমাজ মুক্ত।

১৫. সমাজতান্ত্রিক সমাজে শিশু লালন পালনের ব্যবস্থাটি পারিবারিক ও সামাজিক উভয় দিকের সদ্ব্যবহারের সম্মিলিত লালনের ভিত্তিতে হবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেশব্যাপী শিশুসদন ও শিশুনিবাস থাকে। শিশুনিবাসগুলো হবে অত্যাধুনিক, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব। চিকিৎসা ও শিক্ষাকর্মীরা শিশুদের সব দায়িত্ব পালন করবে।

১৬. পুঁজিবাদে নারীকে দেখা হয় পুরুষশাসিত সমাজের ভোগ্যসামগ্রী এবং তারা সন্তান উৎপাদনের বা পেটে বাচ্চা রাখার যন্ত্রবিশেষ। পুঁজিবাদে নারী খাঁচাবদ্ধ ও পরাধীন প্রজাতিবিশেষ। পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক সমাজে নারীরা হয় সব ধরনের পুরুষতান্ত্রিক শোষণ থেকে মুক্ত ও স্বাধীন। এ সমাজে নারীদের স্বাধীনতা হচ্ছে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও মানবিক_ সবদিক থেকে শোষণমুক্ত এক স্বাধীন সমাজের আলোকস্তম্ভ।

১৭. সমাজতন্ত্রে শুধু ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করবার উদ্দেশ্যে ভোগ্যদ্রব্য বা ব্যবহার্য দ্রব্যের দাম ধরা হয়। এ সমাজে উৎপাদন হয় পরিকল্পনা অনুসারে, দামও পরিকল্পিত হয় এমনভাবে যাতে উৎপাদিত সমস্ত দ্রব্য জনসাধারণের ভোগে লাগতে পারে। এখানে উৎপাদন ও ব্যবহারের ভিতর কোনো অসামঞ্জস্য তৈরি হয় না। বিপণন কেন্দ্রগুলোতে যা পাওয়া যায় তার সবটাই নাগরিকগণ কিনতে সমর্থ হয়। এক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির অর্থই হলও বিপণন কেন্দ্রগুলোতে প্রাপ্য জিনিসের বৃদ্ধি এবং তার ফলে নাগরিকদের ক্রয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি।

১৮. সমাজতন্ত্রের অর্থই হলও পুলিশ ফৌজ ও আমলাতন্ত্রের বিলোপ। এ সমাজে গড়ে উঠবে জন-মিলিশিয়া এবং জাতীয় রক্ষী বা জন স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষা করার জন্য স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজন নেই, সে কাজের জন্য জাতীয় রক্ষী বা জন স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের প্রত্যেক সদস্য যদি যথার্থ সামরিক প্রশিক্ষণসহ সশস্ত্র হয়, তাহলে কোনো সমাজতান্ত্রিক এমনকি জনগণতান্ত্রিক দেশেরও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সমাজতান্ত্রিক দেশ আক্রমণকারী দেশ হবে না, বা অস্ত্র প্রতিযগিতায় অবতীর্ণ হবে না। জনগণের রাষ্ট্রকে জনগণই রক্ষা করবে। পুলিশের বদলে জনমিলিশিয়াই যথেষ্ট।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক দল গঠন প্রসঙ্গে

১৯. সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্রে ধর্মের সংগে রাষ্ট্রের কোনোরূপ সম্পর্ক থাকবে না, ধর্ম হবে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনোরূপ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অর্থব্যয় থাকবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ সমাজ হয় সব রকম প্রগতিমুখী যুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর এক সমাজ যা ধর্মের বিলোপের দিকে যেতে থাকবে। দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকেন্দ্রিক এ সমাজের সদস্যবৃন্দ নিজেকে ধর্মবর্জিত করে তুলবে_ ধর্মের অবয়ব থেকে মুক্ত এক সত্যিকার বাস্তবিক মানবসমাজ নির্মাণে সাম্যাকাঙ্ক্ষী হবে এই সমাজ।

২০. সমাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদের আদর্শ অনুসরণ করে বাস্তবে পরিচালিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটা হয় গণতান্ত্রিক আর প্রস্তাবিত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটা হয় কেন্দ্রিকতাবাদভিত্তিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল নীতি হিসেবে ভ্লাদিমির লেনিন ও মাও সেতুং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদের আদর্শগত ধারণার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

২১. সমাজতন্ত্র হচ্ছে একটি বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া। পৃথিবীর সমস্ত দেশে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ। পৃথিবীর দেশে দেশে নিরন্তর বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে ছড়িয়ে দেয়ায় হচ্ছে প্রলেতারিয়েতের কাজ। লেনিনের মতানুসারে পুঁজি হচ্ছে এক জবরদস্ত আন্তর্জাতিক শক্তি; তাই এই শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সফল করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রলেতারিয় সম্প্রীতি ও প্রলেতারিয় মৈত্রীর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সকল দেশের শ্রমিকশ্রেণি এবং নিপীড়িত জাতি ও জনগণকে এক করেই সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা যায়।

২২. সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। সমাজের সকল সদস্যের ভেতরে মৈত্রী স্থাপিত হওয়া এই সমাজের একটি লক্ষণ। ব্যক্তিকে সামাজিক সত্ত্বা হিসেবে সার্বিকভাবে বিকশিত করার দায়িত্ব নেয় সমাজতন্ত্রের সভ্যগণ। সমাজতন্ত্র অভিমুখী সকল রাষ্ট্রের সাথে মৈত্রীমূলক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সমাজতান্ত্রিক সমাজের দৃঢ় ভিত্তি। সমাজতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণি তার শ্রমের প্রক্রিয়া ও শ্রমের ফল থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বিধায় সে সমবেত সকল মানুষের বিকাশের জন্য শ্রমে জীবন্ত ও নিবেদিত।  

বি. দ্র. বিভিন্ন পুস্তক থেকে এই বৈশিষ্ট্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে মার্কসবাদী বিভিন্ন রচনা এসবের সূত্র। ভবিষ্যতে প্রদানের ইচ্ছে রইলো। প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য আলাদাভাবে একটি করে নিবন্ধ বা প্রবন্ধ লিখে বিষয়গুলো বিস্তারিত করার ইচ্ছা রইলো। প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ২১-২৮ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশিত হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ১২ অক্টোবর, ২০১৪

Leave a Comment

error: Content is protected !!