আধুনিক সমাজতন্ত্রের ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব-এর (ইংরেজি: French Revolution) প্রাক্কালে এবং শিল্প বিপ্লবের ফলে সেটির রূপ পালটে গিয়েছিল। তবুও একথা বলা যায় যে এই বিপ্লবের বহু পূর্বে অতীতকালের নানা ধারণা এবং আন্দোলনগুলোতে সমাজতন্ত্র তার স্থান করে নিয়েছিল। ১৮৪৮ সালের ইউরোপীয় বিপ্লবের পূর্বমুহূর্তে সেই বছরেই কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস কর্তৃক কমিউনিস্ট ইশতেহার লিখিত হলে সেখানেই তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেন। উনিশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকেই মার্কসবাদের টানে ইউরোপে সমাজতন্ত্রী ও সমাজ গণতন্ত্রী দলগুলো গড়ে উঠেছিলো। অস্ট্রেলিয় শ্রমিক দল ছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল যেটি ১৮৯৯ সালে কুইন্সল্যান্ডের প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়লাভ করে।[১]
ফরাসি বিপ্লবের মূল লক্ষ্য সমাজতন্ত্র ছিল না যদিও সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের জন্মাগার ছিল সেটিই। ফরাসি বিপ্লবের সংগে পরবর্তীকালের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বৃহত্তম যোগসূত্র ফ্রঁসোয়া নোয়েল ব্যাবুফ (২৩ নভেম্বর ১৭৬০ – ২৭ মে ১৭৯৭) প্রাচীন রোমের বিপ্লবী গ্রাকাসের নাম তিনি গ্রহণ করেছিলেন। গ্রাক্কাস ব্যাবুফ, দার্থে (১৭৬৯ – ২৭ মে ১৭৯৭), সিলভা মারেশাল (১৭৫০ – ১৮০৩) ও আরো কয়েকজন মিলে ‘সমানপন্থিদের ষড়যন্ত্রে’র (Conspiracy of the equals) শরিক হয়েছিলেন এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল। ব্যাবুফ দার্মে এবং আরো অনেকে পরের বছর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। বিচারের সময় তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, জ্যাকববাদ, সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতা ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের প্রশ্ন তোলা হয়নি বললেই চলে। তবু ভবিষ্যতের দিকে তাকালে ব্যাবুফপন্থিদের গুরুত্ব অসীম। সমানপন্থিরা (Egaue) ক্ষমতা দখলের স্পষ্ট পরিকল্পনা চিত্রিত করেছিল। বিপ্লবোত্তর সমাজ সম্বন্ধেও তাঁদের এক ধরনের পরিকল্পনা ছিল, সেটি যতই সাদামাটা হোক না কেন। ‘সমানপন্থিদের ইশতেহার’ (Manifeste des Egaux) বা ‘নিম্নবর্গের মানুষের ইশতেহার’ (Manifeste des plebeins) তারই প্রতিফলন। বিপ্লবের উদ্দেশ্যে সমানপন্থিরা জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচার ও সংগঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন। বিপ্লবের জন্য হিংসা, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং বিপ্লবের পর কিছুদিন যে একনায়কতন্ত্র দরকার, তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন। তারা উল্লেখ করেছিলেন, অর্থনীতি পরিচালনা করবে একটি বিশেষ সংস্থা (Economic council)। যন্ত্রশিল্পের প্রসার এবং পোড়ো জমিতে চাষ উৎসাহিত হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য পুরোপুরি রাষ্ট্রের দখলে থাকবে। দেশের অভ্যন্তরে টাকার ব্যবহার ক্রমে উঠে যাবে। প্রত্যেক কমিউনে উৎপাদকদের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভান্ডার থাকবে। সবাই সমান মজুরি পাবে। দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের মধ্যে তফাত থাকবে না। যাতে অসাম্য আবার মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে সে দিকে কড়া নজর রাখা হবে। যৌথ ও সমবায় কৃষির উল্লেখ আছে, যদিও খুব স্পষ্টভাবে নয়। বিপ্লবী সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা শ্রমের ক্ষেত্রে কাজে লাগাবার কথাও ছিল। রুশ বিপ্লবের (১৯১৭) গোড়ার দিকের শ্রম বাহিনীর ছায়া যেন এখানে মেলে। ভোগের সাম্য এবং উৎপাদনের সাম্য, দুধরনের চিন্তাই লক্ষণীয়।
সমানপন্থিদের ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘ফরাসি বিপ্লব অন্য আরেকটি বিপ্লবের পূর্বলক্ষণ ভিন্ন কিছুই ছিল না, যেটি হবে বৃহত্তর, অধিকতর পবিত্র এবং যেটি হবে শেষ বিপ্লব’। ‘সমানপন্থিদের ষড়যন্ত্র’ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে ‘লাল প্রজাতন্ত্রে’র একেবারে সীমানায় নিয়ে এলো। ব্যাবুফ ও তাঁর সঙ্গীদের রক্তধারা ফরাসি বিপ্লবের ঐতিহ্যকে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক এই দুভাগে ভাগ করে দিল।[৪]
তথ্যসূত্র ও টীকা:
১. Blainey, Geoffrey (2000). A shorter history of Australia. Milsons Point, N.S.W.: Vintage. p. 263. ISBN 1-74051-033-X.
২. সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, ফরাসি বিপ্লবে নিম্নবর্গের মানুষ ও অন্যান্য প্রবন্ধ; প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা; মে, ২০০২; পৃষ্ঠা- ৩৫-৩৬।
৩. ব্যাবুফের উদ্ধৃতিতে ইংরেজি বাক্যটি এরকম: “The French Revolution was nothing but a precursor of another revolution, one that will be bigger, more solemn, and which will be the last.”
৪ প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৮২-৮৪ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো।
রচনাকালঃ আগস্ট ২, ২০১৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।