এক দেশে সমাজতন্ত্রের (ইংরেজি: Socialism in one country) তত্ত্বটি মূলত ভ্লাদিমির লেনিনের উদ্ভাবিত। ১৯২৪ সালে জোসেফ স্তালিন এটিকে সামনে নিয়ে আসেন, ১৯২৫ সালে নিকোলাই বুখারিন এটিকে বিস্তৃত করেন এবং অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন এটিকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করে।
ইউরোপে ১৯১৭-১৯২১ সালের ভেতরে জার্মানি এবং হাংগেরিতে প্রলেতারিয় বিপ্লবের পরাজয় বলশেভিকদের আসন্ন বিশ্ব-বিপ্লবের আশাকে শেষ করে দেয় এবং স্তালিনকে “এক দেশে সমাজতন্ত্রের” ধারনাকে বিকশিত করতে বাধ্য করে। মার্কসবাদে, এই ঘটনার পূর্বে, বলা হতো যে সমাজতন্ত্র অবশ্যই গোটা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; এবং এখান থেকেই লিওঁ ত্রতস্কি’র সাথে “চিরস্থায়ি বিপ্লবের” বিতর্কে স্তালিনসহ অনেক বিশেষজ্ঞ জড়িয়ে পড়েন।
এক দেশে প্রলেতারিয় বিপ্লব সম্পর্কে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁর বিখ্যাত প্রশ্নোত্তরের পুস্তিকা ‘কমিউনিজমের নীতিমালা’তে অক্টোবর, ১৮৪৭ সালে একটি প্রশ্নে লিখেছিলেন, প্রলেতারিয়ান ‘বিপ্লব কি কোনো একটি দেশে এককভাবে সংঘটিত হতে পারবে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন,
“না। বিশ্ববাজার সৃষ্টি করে বৃহদায়তন শিল্প পৃথিবীর সকল জাতিকে, বিশেষ করে সভ্য জাতিগুলোকে, পরস্পরের সংগে এমন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত করে দিয়েছে যে, অন্যদের কি ঘটছে তা থেকে কেউই মুক্ত নয়। অধিকন্তু বৃহদায়তন শিল্প সকল সভ্যদেশের সমাজ উন্নয়নকে এতোই সম্পর্কিত করেছে যে তাদের সকলের মধ্যে বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত_ এই দুটি শ্রেণি নির্ধারক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে, এবং তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বই আজকের সময়ের প্রধান দ্বন্দ্ব। সুতরাং কমিউনিস্ট বিপ্লব নিতান্তই জাতীয় বিপ্লব হবে না; সকল সভ্য দেশে_ অন্তত ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে_ একই সময়ে এই বিপ্লব ঘটবে। এইসব দেশের প্রত্যেকটির অভ্যন্তরীণ অবস্থার মধ্যে আরো উন্নত শিল্প, অধিকতর সম্পদ এবং উৎপাদনী শক্তিসমূহের আরো গুরুত্ববহ জনগোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে আরো দ্রুত কিংবা আরো ধীর গতিতে বিকশিত হবে বিপ্লব। সুতরাং জার্মানিতে বিপ্লব হবে সবচাইতে ধীর গতিতে এবং সেখানে বিপ্লব সব চাইতে বেশি বাধারও সম্মুখীন হবে, সব চাইতে দ্রুত এবং সব চাইতে সহজ হবে ইংল্যান্ডে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উপর এর বিরাট ও গভীর প্রভাব পড়বে এবং তাদের এ যাবত কালের উন্নয়নের ধারাকে মৌলিকভাবে বদলে দেবে_ ত্বরান্বিত করবে। এ হবে বিশ্বব্যাপী বিপ্লব; সুতরাং এর পরিধিও হবে বিশ্ববিস্তৃত।”[১]
অর্থাৎ মার্কস এবং এঙ্গেলসের বিপ্লবের মানচিত্রে রাশিয়া নামক ভূখণ্ড শুরুতে ছিলোই না। তাহলে কী লেনিন ও বলশেভিকরা ১৯১৭ সালে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়েছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে হঠকারিতা করেছিলেন? এইখানেই রয়েছে মার্কসবাদের বিকাশের বিষয়, এটি কোনো অনড় বৈদিক মন্ত্র নয়। মার্কসবাদ সক্রিয়তার নির্দেশ। মার্কস এবং এঙ্গেলসের কথাকে আঁকড়ে বসেছিলেন ইউরোপের সব আপোষপন্থী সমাজতন্ত্রীরা, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতারা এই বলে নিষ্ক্রিয়তার যুক্তি খুঁজতেন যে মার্কস তো বলেই গেছেন ইউরোপে এখনও পুঁজিবাদ বিকশিত হচ্ছে; সুতরাং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঝামেলা পোহানোর এখন দরকার নাই। এসব আপোষপন্থীদের সম্পর্কে উৎপল দত্ত লিখেছেন,
“সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য ইউরোপ তৈরি নয়_ এই ক্লীবের মন্ত্র আওড়াচ্ছিলেন এঁরা এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে নিজ নিজ দেশের শাসকশ্রেণির জাতীয়তাবাদী হিংস্রতায় পর্যন্ত সায় দিচ্ছিলেন”।[২]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে দীর্ঘ সময় ধরে সুবিধাবাদীরা জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তার নীতি গ্রহণ করে। সুবিধাবাদীরা মার্কসবাদকে বেদবাক্য মনে করে নিষ্ক্রিয় থেকেছে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের আগেও, এবং এর বিপরীতে লেনিন দেখালেন পশ্চাৎপদ দেশেও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম করা যায়, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়। ভি. আই. লেনিন লিখলেন,
“আমি জানি কিছু ঋষি আছেন যারা নিজেদের খুব বুদ্ধিমান ভাবেন, এমনকি নিজেদের সমাজতন্ত্রিও বলেন, যারা বলে থাকেন, সবদেশে একসংগে বিপ্লব ফেটে পড়ার আগে আমাদের দেশে ক্ষমতাদখল করা উচিত হয়নি। তারা বুঝতে পারছেন না, এইসব উক্তি করে তারা বিপ্লবের পক্ষ ত্যাগ করে বুর্জোয়াদের দলে যোগ দিচ্ছেন। জগতজুড়ে বিপ্লব শুরু না হলে অপেক্ষা করাই সমীচীন, একথা বলার অর্থ হলো_ সবাই জবুথবু হয়ে অনন্তকাল অপেক্ষাই করতে থাকো। এটা বাজে কথা।”[৩]
ভ্লাদিমির লেনিন সারা জীবন প্রচার করেছেন যে পুঁজি হলো এক আন্তর্জাতিক শক্তি। তাকে পরাস্ত করতে হলে দরকার শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক জোট, তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব। আর এই ভ্রাতৃত্বকে সমাজতন্ত্রে নিয়ে যেতে হলে চাই দেশে দেশে ক্ষমতা দখল, দেশে দেশে বিপ্লব সংঘটিত করা। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতা দখল হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অন্য কোনো দেশে প্রলেতারিয়েতগণ ক্ষমতা দখল করতে পারে না। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে নিজের দেশের উপরেই টিকে থাকতে হয়েছে যার নজির মানবেতিহাসে আর নেই।
মার্কস বলেছিলেন যে প্রাচুর্য ব্যতীত সমাজতন্ত্র হবে না। সমাজতন্ত্র শুরু হবে মানুষের জীবনধারণের সামগ্রীর চাহিদা মিটে যাওয়ার পর, দ্রব্যের প্রাচুর্য সৃষ্টি হবার পর। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পশ্চাৎপদ একটি দেশে ক্ষমতা গ্রহণ করে মানুষের প্রাথমিক চাহিদা মেটানোর কাজে নেতাদেরকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। আর সাম্রাজ্যবাদ চাপিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধ। এসব মনে না রাখলে স্তালিন ত্রতস্কির বিতর্ককে ভুল জায়গা থেকে দেখা হবে।
রাশিয়া ছিলো ছোট ছোট গ্রামীণ কৃষকনির্ভর পশ্চাৎপদ দেশ, শ্রমিক শ্রেণি ছিল সংখ্যায় অল্প এবং বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ে লড়ে ক্লান্ত। দেশে ভারি শিল্প নেই বললেই চলে, তাই ভোগ্যপণ্য তৈরি করার পথ ছিলো না। এরকম এক আমলা নির্ভর দেশকে সমাজতন্ত্রের দিকে নেবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন লেনিন-স্তালিন। নভেম্বর বিপ্লবের ১১ বছর পরে ১৯২৮ সালে স্তালিন রিপোর্টে বলছেন যে,
“আমাদের দেশে যদি জার্মানির মতো উচ্চ বিকশিত কারখানা শিল্প থাকত, … … তাহলে পুঁজিবাদী দেশগুলোর পেছনে পড়ে যাব এই ভয় থাকত না। আমরা অনেক ধিরে সুস্থে কারখানা গড়ে তুলতে পারতাম, এবং জানতাম এক ঝটকায় পুঁজিবাদী দেশগুলোকে টপকে যাওয়ার ক্ষমতা আমরা ধরি। কিন্তু বাস্তবে আমরা যন্ত্রবিদ্যায় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ রকম অনগ্রসর।”[৪]
এই কথার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে অতি দ্রুত ভারি শিল্প গড়তে গিয়ে অর্থনীতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে_ যদি বিপ্লবটি জার্মানিতে ঘটত তবে তা হতো না। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে মার্কসের প্রাচুর্য পরবর্তী সমাজতন্ত্রের কথা এবং লেনিন-স্তালিনের দ্রুত শিল্পায়নের তাগিদ ও সোভিয়েতে ভোগ্যপণ্যের স্থায়ী অভাবের সমস্যার কথা। ত্রতস্কির ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র গড়া যায় না’ এই তত্ত্বকে স্তালিন কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে লিখলেন,
“শিল্পায়নের উচ্চগতি বজায় রাখার প্রশ্নই উঠত না, যদি আরো একাধিক দেশে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব কায়েম থাকত, আরো অগ্রসর দেশে_ যেমন ফ্রান্স এবং জার্মানি। … তাহলে আমাদের অর্থনীতি ঐসব দেশের উন্নততর উৎপাদন শৃঙ্খলার অংশ হতে পারত, সেখান থেকে আসত আমাদের যন্ত্রপাতি, এবং আমাদের কৃষি ও শিল্প আরো উৎপাদনশীল হতে পারত, এবং আমরাও ওদের কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারতাম।”[৫]
ত্রতস্কি স্তালিনের বিপরীত মত রেখে অনবরত বলে গেছেন, এককভাবে সমাজতন্ত্র গড়া যায় না। স্তালিনও সেই একই সিদ্ধান্তে এসেছেন বহুবার। যেমন ১৯২৪ সালের মে মাসে লেনিনবাদের সমস্যা পুস্তকে স্তালিন লিখেছিলেন,
“সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত জয়লাভের জন্য, সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সংগঠিত করার জন্য, একটি দেশের চেষ্টা, বিশেষ করে রাশিয়ার মতো একটি কৃষি প্রধান দেশের চেষ্টা যথেষ্ট নয়; তার জন্য কয়েকটি উন্নত দেশের শ্রমিকদের চেষ্টার প্রয়োজন।”[৬]
গত প্রায় নয়টি দশক ধরে স্তালিন-ত্রতস্কির বিতর্কটিকে যত বড় করে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা দেখিয়েছে তা আসলে তত বড় ছিলো না। সোভিয়েত পার্টিতে এই বিতর্কটি চরম আকার ধারন করে ১৯২৪ সালের পরে এবং চলতে থাকে বেশ কয়েক বছর। স্তালিন লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।[৭]
একদেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব কিনা এই বিতর্কে ত্রতস্কিদের কথার সারমর্ম ছিলো ক্ষমতা পুনরায় বুর্জোয়াদের হাতে সমর্পণ করার। যেহেতু ইউরোপের অগ্রসর দেশগুলোতে বিপ্লব হচ্ছে না এবং রাশিয়ার প্রলেতারিয়েত একা সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ করতে পারবে না, তাই রাশিয়ার প্রলেতারিয়েত ক্ষমতা বুর্জোয়ার কাছে ছেড়ে দিক। উৎপল দত্ত লিখেছেন,
“রাষ্ট্রক্ষমতা পুনরায় বুর্জোয়ার হাতে সমর্পণ করার যেহেতু প্রশ্নই ওঠে না, তাই কর্মবীর স্তালিন তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন বাধা অতিক্রম করে যথাশীঘ্র সম্ভব এমন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবেন যা স্থায়ী হবে।”[৮]
ত্রতস্কির বিতর্কের কথাগুলোর দিকে আমরা নজর দিলে ত্রতস্কির মনোভাব হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। এক দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার বিতর্কের চরম সময়ে তিনি লিখেছিলেন,
“ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েতের রাষ্ট্রীয় সাহায্য না পেলে, রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণি নিজেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখতে পারবে না।, তার অস্থায়ী শাসনকে সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্বে রূপান্তরিত করতেও পারবে না।”[৯]
কথাটিকে আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ত্রতস্কি বলেছিলেন,
“একটি পশ্চাৎপদ দেশে শ্রমিকদের সরকার দাঁড়িয়ে আছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকদের মাঝখানে। এ সমস্যার সমাধান হতে পারে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশ্ব শ্রমিক বিপ্লবের রণাঙ্গনে।[১০]
লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা গ্রন্থ এবং অন্যান্য লেখায় স্তালিনের ঝোঁকটা ছিলো অক্টোবর বিপ্লবের সৃষ্টিশীলতা প্রতিপাদনে এবং এক দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার সম্ভাব্য পরীক্ষা নিরীক্ষার উপর। রাষ্ট্রক্ষমতা পুনরায় বুর্জোয়াদের হাতে ছেড়ে দিলে অক্টোবর বিপ্লবের কোনো অর্থ থাকে না। কিন্তু স্তালিনের কথার তাৎপর্য সেসময় সোভিয়েত পার্টির অধিকাংশ নেতাই উপলব্ধি করেননি। নতুবা স্তালিন রচনাবলীর নিম্নোক্ত লাইনগুলো তাঁদের দৃষ্টি এড়াতো না,
“এক দেশে সমাজতন্ত্রের জয়লাভের সম্ভাবনা বলতে আমরা কি বুঝি?
আমরা বুঝি যে, অন্যান্য দেশে শ্রমিক বিপ্লব জয়যুক্ত না হলেও আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যেই প্রলেতারিয়েত বনাম কৃষকদের মধ্যেকার স্ববিরোধের সমাধান করার সম্ভাবনা আছে, অন্যান্য দেশের প্রলেতারিয়েতের সহানুভূতি আর সমর্থনের সাহায্যে প্রলেতারিয়েতের ক্ষমতা দখলের এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে আমাদের দেশে সম্পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার সম্ভাবনা আছে।
এই সম্ভাবনা ছাড়া সমাজতন্ত্র গড়ার চেষ্টার অর্থ হলো উদ্দেশ্যহীনভাবে কাজ করা, সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যাবে কীনা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে কাজ করা। সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে, আমাদের দেশে শিল্প কৌশলের দিক দিয়ে অনুন্নত হওয়া সত্বেও পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার পথে তা অনতিক্রম্য বাধা হবে না_ এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে সমাজতন্ত্র গড়ার চেষ্টা অর্থহীন। এই সম্ভাবনা অস্বীকার করার অর্থ হলো, সমাজতন্ত্র গড়ার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, লেনিনবাদকে পরিত্যাগ করা।
অন্যান্য দেশের বিপ্লবের জয়লাভ ছাড়া এক দেশে সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ চূড়ান্ত জয়লাভ অসম্ভব_ একথা বলতে আমরা কী বুঝি?
আমরা বুঝি যে, অন্তত কয়েকটি দেশে বিপ্লব সফল না হলে বিদেশি হস্তক্ষেপের হাত থেকে_ সুতরাং বুর্জোয়া সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার হাত থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হওয়া অসম্ভব। এই অনস্বীকার্য সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করার অর্থ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিসর্জন দেয়া, লেনিনবাদকে পরিত্যাগ করা।”[১১]
এই কথা বলে স্তালিন লেনিনের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন,
“আমরা শুধু একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বাস করছি তাই নয়, আমরা বিভিন্ন রাষ্ট্র দিয়ে গঠিত এক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির পাশাপাশি দীর্ঘকাল ধরে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব অচিন্ত্যনীয়। শেষ পর্যন্ত দুটোর একটাকে জয়লাভ করতে হবে। এবং এই শেষ সময় ঘনিয়ে আসবার আগে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র আর বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অনেকগুলি ভয়াবহ সংঘর্ষ অনিবার্য।”[১২]
সোভিয়েতের বিলুপ্তি যে লেনিনের দৃষ্টির বাইরে ছিলো না, তাঁর এই উদ্ধৃতি তার সৃজনীশক্তির পরিচয়কে তুলে ধরে। লেনিন দেখেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলির ভেতরে সংঘর্ষ অনিবার্য এবং শেষ পর্যন্ত একটি জয়লাভ করবে। লেনিন, স্তালিন ও ত্রতস্কি, তিনজনেরই দৃষ্টিতে ছিলো এই সত্যটি যে সমাজতন্ত্র অভিমুখী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো একসাথে অসীমকাল পৃথিবীতে বিরাজ করবে না। ১৯৯০-৯১ সালের সোভিয়েতের বিলুপ্তির দায় শুধু সোভিয়েত নেতাদের দিলে বিষয়টিকে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখা হয় না, সোভিয়েতের বিলুপ্তির দায় ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কাঁধেও কিছুটা বর্তায়। সাম্রাজ্যবাদীরা জানত যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে সোভিয়েতে সমাজতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হতে বাধ্য, ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্সকে আক্রমণ করে ইউরোপের প্রতিক্রিয়াশীলরা আগে থেকেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলো। ফলে ইউরোপের ১৮টি দেশের আক্রমণ, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, পশ্চাদপদতার ফলে রাশিয়ার বিপ্লব একটি গতিহীনতার বেড়াজালে আটকে যায়। অর্থনৈতিকভাবে আরো অনেক অগ্রসর ইউরোপের দেশগুলোর বিপ্লবী সহায়তা ছাড়া রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের স্থায়ীত্ব খুব দুরূহ ছিলো এবং স্তালিন সেই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদি ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপ্লব সাফল্য পেত তবে তারা তাদের প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তিকে একত্রিত করে বিপুল সাফল্যের সাথে দুনিয়ার বাকী অংশে বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ইউরোপের ভুয়া কমিউনিস্টদের দ্বারা সেকাজটি করা সেসময় একেবারেই অসম্ভব ছিলো যা ইতিহাস প্রমাণ করেছে।
তথ্যসূত্র ও টীকা:
১. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিজমের নীতিমালা, আফজালুল বাসার অনূদিত, নন্দন প্রকাশন, অক্টোবর, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৫।
২. উৎপল দত্ত, প্রতিবিপ্লব, এমসি সরকার এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভাদ্র, ১৪০০, পৃষ্ঠা ৫,
৩. ভি. আই. লেনিন, Collected Works, Vol.13 page 9
৪. Stalin, Collected Works, Vol.11 page 261
৫. Stalin, Collected Works, Vol.11 page 261
৬. ইংরেজি বাক্যগুলো এরকম; For the final victory of socialism, for the organisation of socialist production, the efforts of one country, particularly of a peasant country like Russia, are insufficient; for that, the efforts of the proletarians of several advanced countries are required” (see The Foundations of Leninism, first edition) ইংরেজিটি পড়ুন, http://marxists.org-এ।
৭. আপনারা দেখুন, জে ভি স্তালিন, নবগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, এনবিএ, কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ২০০৯ পুস্তকটি।
৮. উৎপল দত্ত, প্রতিবিপ্লব, এমসি সরকার এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভাদ্র, ১৪০০, পৃষ্ঠা ৮,
৯. Trotsky, “Our revolution”, New York, 1940, p 278.
১০. Trotsky, Preface to “The year 1905” New York, 1941, p 278.
১১. জোসেফ স্তালিন, নবগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, এনবিএ, কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ২০০৯, পৃষ্ঠা ১১৭ ও ১১৮। ইংরেজিটি পড়ুন, http://marxists.org-এ।
১২. জোসেফ স্তালিন, নবগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, এনবিএ, কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ২০০৯, পৃষ্ঠা ১১৭ ও ১১৮ ও Lenin, Collected Works, Vol. XXIV, p. 122
১৩ প্রবন্ধটি আমার ২০১৫ সালে ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ১১৩-১২১ পৃষ্ঠায় আছে এবং এখানে সামান্য সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ২৫ অক্টোবর, ২০১৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।