১৯২০ সালের ২ অক্টোবর রাশিয়ার কমিউনিস্ট যুবলীগের তৃতীয় সারা রাশিয়া কংগ্রেসে ভাষণ
(লেনিনের উদ্দেশে কংগ্রেসের তুমূল অভিনন্দনোচ্ছাস।) কমরেডগণ, আমি আজ আলোচনা করতে চাই যুব কমিউনিস্ট লীগের মূল কর্তব্য কী এবং এই প্রসঙ্গেই, সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সাধারণভাবে যুবজনের কীরূপ সংগঠন হওয়া উচিত তাই নিয়ে।
সমস্যাটি আলোচনা করা আরও আবশ্যক এইজন্য যে, কমিউনিস্ট সমাজ সৃষ্টির সত্যিকার কর্তব্য পড়বে যুবজনেরই ওপর। কারণ একথা পরিষ্কার যে কর্মীদের যে-পুরুষ পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ হয়েছে তারা শোষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত সাবেকী পুঁজিবাদী সমাজ জীবনের বুনিয়াদটাই বড়ো জোর ধ্বংস করতে পারে। বড়ো জোর এমন একটা সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির কর্তব্য পালন করতে পারে তারা, যা প্রলেতারিয়েত ও মেহনতী শ্রেণীগুলির হাতে ক্ষমতা বজায় রাখতে ও পাকা বুনিয়াদ গড়তে সাহায্য করবে, যার ওপর নির্মাণ করে তুলতে পারবে কেবল সেই প্রজন্ম যারা নতুন পরিস্থিতিতে, মানুষে মানুষে শোষণ যখন আর থাকছে না তেমন অবস্থায় কাজ আরম্ভ করছে।
তাই, এই দৃষ্টিকোণ থেকে যুবজনের কর্তব্য সম্পর্কে এগুলে বলতেই হবে যে, সাধারণভাবে যুবজনের এবং বিশেষ করে যুব কমিউনিস্ট লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের কর্তব্য ব্যক্ত করা যায় একটি কথায় : শিখতে হবে।
অবশ্যই এটা মাত্র ‘একটি কথা’। প্রধান ও সর্বাধিক জরুরি প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তাতে, যথা: কী শিখব, কী করে শিখব? এক্ষেত্রে গোটা কথাটাই হলো এই যে, সাবেকী পুঁজিবাদী সমাজের রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে যে-নতুন প্রজন্মগুলো কমিউনিস্ট সমাজ গড়ে তুলবে তাদের শেখান, মানুষ করে তোলা ও তালিম দেবার কাজটাও পুরনো ধারায় চালান যায় না। যুবজনকে শেখান, মানুষ করে তোলা ও তালিম দেবার কাজ চালাতে হবে সাবেকী সমাজ যে-মালমসলা রেখে গেছে তাই থেকেই। কমিউনিজম আমরা নির্মাণ করতে পারি কেবল সাবেকী সমাজ যে জ্ঞান, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সমাহার, মানবিক বল ও উপায়াদির ভান্ডার আমাদের জন্য রেখে গেছে তা দিয়ে। যুবজনের শিক্ষাদান, সংগঠন ও মানুষ করে তোলার কাজটাকে আমূল পুনর্গঠিত করেই কেবল আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারি যে, তরুণ প্রজন্মের প্রচেষ্টার ফল হবে এমন সমাজের নির্মাণ যা সাবেকী সমাজের মতো হবে না, অর্থাৎ কমিউনিস্ট সমাজের নির্মাণ। সেই জন্যই কী আমরা শেখাব এবং কমিউনিস্ট যুবজন এই নাম সত্যই সার্থক করতে চাইলে কীভাবে যুবজনদের শিখতে হবে, আমরা যা শুরু করেছি তা সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত করতে হলে কীভাবে যুবজনকে তালিম দিতে হবে, এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের বিশদে আলোচনা করা দরকার।
বলতে আমি বাধ্য যে, মনে হবে প্রথম ও সবচেয়ে স্বাভাবিক জবাব হলো, যুবলীগকে এবং যারা কমিউনিজমে পৌঁছতে চায় সাধারণভাবে এমন সমস্ত যুবজনকে কমিউনিজম শিখতে হবে।
কিন্তু ‘কমিউনিজম শিখতে হবে? জবাবটি খুবই ব্যাপক। কমিউনিজম শিখতে হলে আমাদের কী দরকার? কমিউনিজমের জ্ঞান অর্জন করতে হলে সাধারণ জ্ঞানের সমাহার থেকে কোন জিনিসটা বেছে নিতে হবে? এই ক্ষেত্রে একপ্রস্ত বিপদ দেখা দেয় আমাদের সামনে, কমিউনিজম শেখার কর্তব্যটা যখন বেঠিকভাবে হাজির করা হয় বা খুবই একপেশেভাবে তা বোঝা হয়, তখন প্রায়ই সর্বদাই বিপদটি বাধে।
স্বভাবতই, প্রথমে মনে হবে যে, কমিউনিজম শেখা মানে কমিউনিস্ট পাঠ্যপুস্তক, পুস্তিকা ও রচনায় যে-জ্ঞানভান্ডার রয়েছে তা আয়ত্ত করা। কিন্তু কমিউনিজম অধ্যয়নের এমন সংজ্ঞা খুবই স্থল ও অপ্রতুল। কমিউনিস্ট রচনা বইপত্তর, পুস্তিকায় যা আছে কেবল তাই আয়ত্ত করাই কমিউনিজম অধ্যয়ন হলে খুব সহজেই আমরা কমিউনিস্ট পুঁথিবাগীশ, বাক্যবীরদের পেতে পারি এবং তাতে প্রায়ই আমাদের ক্ষতি ও অনিষ্ট হবে, কেননা কমিউনিস্ট বইপত্তর, পুস্তিকায় যা আছে তা পড়ে মুখস্থ করার ফলে এইসব লোকেরা সেই জ্ঞানকে সম্মিলিত করতে ব্যর্থ হবে, কমিউনিজমের যা সত্যিকার দাবি সেভাবে কাজ করতে পারবে না।
সাবেকী পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের জন্য যা রেখে গেছে তেমন একটা বৃহত্তম অকল্যাণ ও দুর্ভাগ্য হলো ব্যবহারিক জীবন থেকে পুস্তকের পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ, কারণ এমন বই আমাদের ছিলো যাতে সবকিছুই যথাসম্ভব চমৎকার করে বর্ণিত হয়েছে, অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন বই হলো অতি ন্যাক্কারজনক ভন্ডামিভরা মিথ্যা, যাতে মিথ্যে করে বর্ণনা করা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজের।
সেইজন্যই কমিউনিজম বিষয়ে বইগুলি থেকে স্রেফ পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত করা অবশ্যই চূড়ান্ত ভুল হবে। কমিউনিজম সম্পর্কে আগে যা বলা হয়েছিলো, এখন আমাদের বক্তৃতা ও প্রবন্ধাদিতে কেবল তারই পুনরাবৃত্তি আমরা করি না, কারণ আমাদের দৈনন্দিন ও সর্বমুখী কাজের সঙ্গে আমাদের বক্তৃতা ভাষণাদি সম্পর্কিত। কাজ ছাড়া, সংগ্রাম ছাড়া কমিউনিস্ট পুস্তিকা ও বইপত্তর থেকে পাওয়া কমিউনিজমের পুঁথিগত বিদ্যা মূল্যহীন, কেননা তত্ত্ব থেকে ব্যবহারের সেই পুরনো বিচ্ছেদই তাতে চলতে থাকবে, সেই সাবেকী বিচ্ছেদ, যেটা সাবেকী বুর্জোয়া সমাজের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক বৈশিষ্ট্য।
কেবল কমিউনিস্ট স্লোগান আয়ত্ত করা শুরু করলে হয়ে পড়বে আরও বেশি বিপদ। সময় থাকতে এই বিপদ হৃদয়ঙ্গম না করলে, বিপদটি দূর করার জন্য আমাদের সব শক্তি নিয়োগ না করলে, যে পাঁচ কি দশ লাখ তরুণ-তরুণী এইভাবে কমিউনিজম শিখে নিজেদের কমিউনিস্ট বলবে, তারা কেবল কমিউনিজমের প্রভূত ক্ষতিই করবে।
এখানে প্রশ্ন ওঠে: কমিউনিজম অধ্যয়নের জন্য এইসব মেলাব কী করে ? সাবেকী স্কুল, সাবেকী বিজ্ঞান থেকে কী আমরা নেব? সাবেকী স্কুল ঘোষণা করেছিলো যে, সে সর্বাঙ্গীণ শিক্ষিত মানুষ গড়তে চায়, সাধারণভাবে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়াই তার কাজ। আমরা জানি এটা একেবারেই মিথ্যা, কারণ শ্রেণিতে শ্রেণিতে, শোষকে শোষিতে লোকেদের ভাগাভাগির ওপরেই ছিলো গোটা সমাজের ভিত্তি, তার ওপরেই তা টিকে থাকত। স্বভাবতই, এই শ্রেণিপ্রেরণায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন থাকায় সমগ্র সাবেকী স্কুলব্যবস্থা জ্ঞানদান করত কেবল বুর্জোয়া সন্তানদের। তার প্রতিটি কথাই ছিলো বুর্জোয়ার স্বার্থে জাল করা। এইসব স্কুলে শ্রমিক-কৃষকদের তরুণ প্রজন্মকে যতটা না মানুষ করে তোলা হতো, তার চেয়ে বেশি তাদের তালিম দেওয়া হত বুর্জোয়ার স্বার্থে। এমনভাবে তাদের গড়ে তোলা হতো যাতে তারা বুর্জোয়ার যুতসই চাকর হতে পারে, তার শান্তি ও আলস্যের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে মুনাফা তুলতে পারে তার জন্য। সেইজন্যই সাবেকী স্কুল বর্জন করার সময় আমরা তা থেকে শুধু সেইটুকু নেওয়া কর্তব্য ধরেছি যা সত্যিকার কমিউনিস্ট শিক্ষালাভের জন্য আমাদের প্রয়োজন।
এইখানটায়, সাবেকী স্কুলের বিরুদ্ধে যে-অনুযোগ ও অভিযোগ আমরা অনবরত শুনি ও যা থেকে প্রায়ই একেবারে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত এসে যায়, সেই কথায় আসছি। বলা হয় যে সাবেকী স্কুল ছিলো ঠেসে মাথা বোঝাই করার, হাবিলদারির, মুখস্থ করার স্কুল। সে-কথা ঠিক, তবে সাবেকী স্কুলের কোনটা খারাপ আর কোনটা আমাদের কাছে উপকারী তার তফাৎ করতে পারা চাই, কমিউনিজমের পক্ষে যা আবশ্যক সেটা তার মধ্য থেকে বেছে নিতে পারা চাই।
পুরনো স্কুল হলো ঠেসে মাথা বোঝাই করার স্কুল, এতে একরাশ নিম্প্রয়োজন অবান্তর প্রাণহীন জ্ঞান রপ্ত করতে বাধ্য হত ছাত্রেরা, যাতে মস্তিষ্ক বোঝাই হয়ে তরুণ প্রজন্ম পরিণত হত একটি একক ছক অনুসারে তালিম পাওয়া আমলায়। কিন্তু মানবিক জ্ঞানের যাবতীয় সঞ্চয় আত্তীকরণ ছাড়া কমিউনিস্ট হওয়া যায়, এই সিদ্ধান্ত টানার চেষ্টা করলে ভয়ানক ভুল হবে। কমিউনিজম নিজেই যে-জ্ঞানসমষ্টির পরিণাম, তাকে রপ্ত না করে কেবল কমিউনিস্ট স্লোগান রপ্ত করা, কমিউনিস্ট বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলি আয়ত্ত করাই যথেষ্ট, এ-কথা ভাবলে ভুল হবে। মানবিক জ্ঞানের সমষ্টি থেকে কীভাবে কমিউনিজমের উৎপত্তি ঘটল তারই নমুনা হলো মার্কসবাদ।
আপনারা পড়েছেন ও শুনেছেন যে কমিউনিস্ট তত্ত্ব, কমিউনিজমের বিজ্ঞান, প্রধানত মার্কসই যা সৃষ্টি করেছেন, সেই মার্কসবাদের শিক্ষামালা এখন আর উনিশ শতকের প্রতিভাধর একক একটি সমাজতন্ত্রীর সৃষ্টি হয়ে উঠেছে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তারা সেই মতবাদ ব্যবহার করছে। মার্কসের শিক্ষা কী করে সর্বাধিক বিপ্লবী শ্রেণির লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি জনের হৃদয় অধিকার করতে পারল, এই প্রশ্ন যদি করেন তবে তার একটি জবাবই পাবেন: তার কারণ পুঁজিবাদের অধীনে সঞ্চিত জ্ঞানের পাকা বুনিয়াদের ওপরেই মার্কস দাঁড়িয়েছিলেন; মানবসমাজের বিকাশের নিয়মগুলি অধ্যয়ন করার পর মার্কস কমিউনিজম অভিমুখে পুঁজিবাদী বিকাশের অনিবার্য্যতা বুঝেছিলেন, সবচেয়ে বড় কথা, সেটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজের অতি যথাযথ, অতি বিশদ ও অতি গভীর অধ্যয়ন থেকেই, পূর্বতন সমস্ত বিজ্ঞানের যাবতীয় সৃষ্টি পুরোপুরি আয়ত্ত করেই। মানবসমাজ যা-কিছু, সৃষ্টি করেছিলো, তা সবই তিনি বিচার করে ঢেলে সাজান, একটি বিষয়ও উপেক্ষা করেন নি। মনুষ্যচিন্তা যা কিছু সৃষ্টি করেছিলো তাকে তিনি ঢেলে সাজান, সমালোচনা করেছেন, শ্রেণির আন্দোলন থেকে তা যাচাই করে নেন এবং এমন সব সিদ্ধান্ত টানেন যা বুর্জোয়া সীমায় সঙ্কুচিত বা বুর্জোয়া কুসংস্কারে আবদ্ধ লোকেরা টানতে পারে নি।
কথাটা আমাদের মনে রাখা উচিত যখন, ধরা যাক, প্রলেতারীয় সংস্কৃতির কথা (২০৭) আমরা বলি। আমরা যদি পরিষ্কার করে এ-কথা না বুঝি যে, মানবজাতির সমগ্র বিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সংস্কৃতির যথাযথ জ্ঞান লাভ করেই এবং সেই সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজিয়েই কেবল, আমরা প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়তে পারি — এ-কথা যদি আমরা না বুঝি তাহলে সমস্যার সমাধান করতে পারব না। প্রলেতারীয় সংস্কৃতি এমন একটা কিছু নয়, যা কোত্থেকে উঠেছে কেউ জানে না, যারা নিজেদের প্রলেতারীয় সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করে, তাদের স্বকপোলকল্পিত উদ্ভাবন তা নয়। ওটা একেবারে বাজে কথা। পুঁজিবাদী সমাজ, জমিদারী সমাজ, আমলাতন্ত্রী সমাজের জোয়ালের নিচে মানবজাতি যে-জ্ঞানভান্ডার জমিয়েছে, প্রলেতারীয় সংস্কৃতিকে হতে হবে তারই সুনিয়মিত বিকাশ। মার্কসের হাতে ঢেলে সাজা অর্থশাস্ত্র যেমন আমাদের দেখিয়েছে মানবসমাজকে কোথায় যেতে হবে, অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে শ্রেণিসংগ্রামে উত্তরণে, প্রলেতারীয় বিপ্লব শুরুর দিকে, ঠিক তেমনিভাবেই এই সমস্ত পথ ও রাস্তা পৌঁছাচ্ছিল, পৌছয় ও পৌছাচ্ছে প্রলেতারীয় সংস্কৃতিতে।
লেখাটি পুরোটা পড়তে নিচের Pages: 1 2 3 4 -এ ক্লিক করে পড়ুন।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।