আসাম বা অসম বা আসাম দেশ (অসমীয়া: অসম অখ়ম্) বর্তমান বিস্তারবাদী ভারত অধিকৃত এক নিপীড়িত, শোষিত পরাধীন অঞ্চল। বাংলাদেশের উত্তরপূর্বে অবস্থিত এই রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত এবং এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা এবং উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। প্রশাসনিক বিভাজনের ফলে আসামে মোট ৩৩টি জেলা গঠন করা হয়েছে। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে আসাম প্রথম উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের অধীনে আসে। এই আসাম প্রধানত চা, রেশম, পেট্রোলিয়াম এবং জীববৈচিত্রের জন্য বিখ্যাত।
আসামে দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অসমীয়া জাতিদম্ভী আচরণ বিরাজমান। বড় জাতিদর্পী অসমীয়া জাতি সেখানকার অন্যান্য ছোট ও দুর্বল জাতিসমূহ এবং জনগণের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণ চালায়। এই শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলে আসছে। আসামের রাজনৈতিক সংকট একটি দীর্ঘমেয়াদী আলোচনার বিষয়।
এই বিষয়ে পড়ুন, অনুপ সাদির প্রবন্ধ বহুজাতিক আসামে উগ্রজাতীয়তাবাদীদের আস্ফালন প্রসঙ্গে?
আসাম দেশ ও প্রাসঙ্গিক ইতিহাস
আধুনিক আসামের ইতিহাস শুরু হয়েছে আসামে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিস্তারের পর থেকে। আসামে উপনিবেশিক যুগের সূচনা হয়েছিল ১৮২৬ সালে ইয়াণ্ডাবুর চুক্তির পরে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এবং ১৯৪৭ সালের পরে ব্রিটিশদের পরিবর্তে দিল্লির নয়া-উপনিবেশিক যুগে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে পূর্বদেশের একটি অংশের, মূলত কলকাতার পুঁজিপতিরা যোগ দিয়েছে দিল্লি সাম্রাজ্যের সাথে।
আসামের ভূপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য
আসাম রাজ্যের মোট এলাকার প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ জুড়ে বনাঞ্চল। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে মেঘালয় এবং মিজোরাম রাজ্য তৈরির ফলে আসামে বনভূমি কমে যায়। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আসামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরসবুজ এবং পাতলা বন, বড়-পাতার পাহাড়ী বন, পাইন বন এবং জলার বন এবং তৃণভূমি সহ বিভিন্ন ধরণের বনভূমিতে আবৃত ছিল। আসামে প্রায় ৭৫ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে যার মধ্যে অনেকগুলোর বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে। শক্ত কাঠের মধ্যে শাল (শোরিয়া রোবস্টা) এবং হোলং (ডিপ্টোকার্পাস রিথাসাস) বৃক্ষগুলি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। বাঁশ, অর্কিড এবং ফার্নও প্রচুর আছে এই রাজ্যে।[১]
আসাম সাফল্যের সঙ্গে একশিঙি গণ্ডার সংরক্ষণ করে এই মহাবিপন্ন প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। এছাড়াও এখানে বাঘ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত রয়েছে। এশীয় হাতির অন্যতম বাসস্থান হলো আসাম। এই রাজ্যটি বন্যপ্রাণী পর্যটনের ক্ষেত্রে ক্রমেই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠছে।
জঙ্গলের বন্যজন্তু এবং মানুষের মধ্যে সংঘাত বাড়া সত্ত্বেও আসামে হাতির সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। গন্ডার, বাঘের মতোই হাতির সংখ্যাতেও পয়লা নম্বরে আসামের কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান। বনমন্ত্রী রকিবুল হুসেন জানান, রাজ্যের ২৫টি সংরক্ষিত অরণ্য, ২০টি অভয়ারণ্য, ৫টি জাতীয় উদ্যান ও রাজস্ব খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত অরণ্য মিলিয়ে ২০১২ সালের এপ্রিলে ৫৬২০টি হাতির সন্ধান মিলেছে। ২০০৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৫৪০০।
আসামে ১৯৯৩ সালে ৫৫২৪টি হাতি ছিল। ২০১২ সালের শুমারি অনুযায়ী, আসামে অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান মিলিয়ে ৩০৫৪টি হাতি রয়েছে। সংরক্ষিত অরণ্য, প্রস্তাবিত সংরক্ষিত অরণ্য ও স্বশাসিত জেলা পরিষদ মিলিয়ে হাতির সংখ্যা ২৫১৬টি। জাতীয় উদ্যানগুলির মধ্যে কাজিরাঙায় ১১৬৫টি হাতি রয়েছে। এটিই সর্বাধিক। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মানস। সেখানে ৯৪৫টি হাতির বাস। তবে, ঘনত্বের বিচারে, প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মানসে হাতি সব থেকে বেশি, ১৮৯টি। কাজিরাঙায় এই সংখ্যা ১৩৫.৬৩। হাতির সংখ্যা সব থেকে কম ওরাং রাজীব গাঁধী জাতীয় উদ্যানে। প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে ৫টি। নামেরিতে ২৩৩ ও ডিব্রু-শইখোয়ায় ১১৫টি হাতি মিলেছে। ২০০৮ সালের সুমারি অনুযায়ী ডিব্রু-শইখোয়ায় ১৬১টি হাতি ছিল। ঘনত্বের বিচারে অবশ্য পয়লা নম্বরে রয়েছে বড়নদী অভয়ারণ্য। প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে, হাতির সংখ্যা ৩৮৯.২টি। বয়সের কাঠামো অনুযায়ী, ৫১ শতাংশ হাতি প্রাপ্তবয়স্ক, ২০ শতাংশ কিশোর, ১২টি শিশু ও ১৭টি নবজাতক। স্ত্রী-পুরষ অনুপাতের হিসাব ১:১.২ (৪৫:৫৫)।[২]
আসাম ছাড়াও ভারত এই অঞ্চলে দখল করে রেখেছে আরো ছয়টি রাজ্য; যথা অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, এবং মেঘালয়। এবং আসাম অন্যান্য ছয়টি দেশ দ্বারা বেষ্টিত। এই সাতটি দেশকে একত্রে সাতবোনী দেশ বলা হয়। শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক দ্বারা ভারত আসামসহ প্রতিটি দেশের উপর তার আধিপত্য বা বিস্তারবাদ বজায় রাখছে। এই শিলিগুড়ি করিডোর হচ্ছে একটি সংকীর্ণ অংশ যার দ্বারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে এই সাতটি দেশ সংযুক্ত। এছাড়াও আসামের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূটান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে।
তথ্যসূত্র
১. Hariprasanna Das, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ব্রিটানিকা ডট কম, সংগ্রহ ১ জুলাই ২০২০, https://www.britannica.com/place/Assam
২. নিজস্ব সংবাদদাতা, গুয়াহাটি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ এপ্রিল ২০১২, “অসমে হাতির সংখ্যা বেড়ে হল ৫৬২০”, http://archives.anandabazar.com/archive/1120402/2jibjagat3.html
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।