আগস্ট আন্দোলন হচ্ছে ১৯৪২ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতারণাপূর্ণ আন্দোলন

১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় জনগণের শত্রু সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতাকে জমিদার ও শিল্পপতিদের করায়ত্ত করবার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতারণাপূর্ণ আন্দোলন আরম্ভ করে তা আগস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত।

এই শতাব্দীর বিশের দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবি প্রবল হতে শুরু করে। বিশের এবং ত্রিশের দশকে বিভিন্ন প্রকার আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে এবং তার চেয়েও জঙ্গী শ্রমিক-কৃষকদের জীবিকার সংঘবদ্ধ আন্দোলন এবং মধ্যবিত্তের বিপ্লবী কার্যক্রমে এই স্বাধীনতার দাবির তীব্রতা প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু একদিকে ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি এবং অপরদিকে ভারতের প্রধান রাজনীতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অনৈক্যের কারণে ভারতে স্বাধীনতার আন্দোলন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত সফলতা অর্জন করতে পারে নি।

১৯৩৯ সালে ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে এই যুদ্ধ এশিয়াতে বিস্তারিত হয়। জাপান অক্ষশক্তি, অর্থ্যাৎ জার্মানি ও ইতালির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। মিত্রপক্ষের প্রধান শক্তি ছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরাধীন ভারতও ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৪২-এ এশিয়াতে যুদ্ধের সীমানা ব্রহ্মদেশে অতিক্রম করে বাংলার নিকটে এসে পড়ে। ব্রহ্মদেশও তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ব্রহ্মদেশ পরিত্যাগ করে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। জাপান কলকাতা নগরী ও চট্রগ্রামের উপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। ব্রিটিশ সরকার তখন একটা সামরিক বিপর্যয়ের সষ্মুখীন। ব্রিটিশ সরকারের এই সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার শত্রু জমিদার ও শিল্পপতিরা উত্তম সময় বিবেচনা করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের নিকট ৪২-এর আগস্ট মাসে একটি প্রস্তাব মারফত কতগুলি দাবি উত্থাপন করে। ভারতীয় জাতীয় কমিটির ওয়ার্কিং কংগ্রেসের এই প্রস্তাব আগস্ট প্রস্তাব নামে পরিচিত।

প্রস্তাবটির এক অংশে সরকারের নিকট অবিলম্বে ভারতের স্বাধীনতা ভারতের জমিদারদেরকে প্রদানের দাবি করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, মিত্রপক্ষের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ভারতের স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীন ভারতের স্বাধীন সরকারই মাত্র মিত্রপক্ষকে যুদ্ধ জয়ে উপযুক্ত রূপে সাহায্য করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ কংগ্রেস ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। প্রস্তাবের অপর অংশে গান্ধীর নেতৃত্বে গণআন্দোলন শুরু করার কথাও বলা হয়েছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের আশা ছিল, তাদের স্বাধীনতার দাবি এবং আন্দোলনের হুমকিতে ব্রিটিশ সরকার তাদের সঙ্গে আপোস আলোচনাতে সম্মত হবে। কিন্তু ভারতের জমিদার ও শিল্পপতিদের মত তখনো শ্রমিক কৃষক বিরোধী জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বিভক্ত। ভারতের সাম্প্রদায়িক বর্বর দুই সংগঠন কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ তখন ছিলো জমিদারদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার জন্য উদগ্রীব এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এটাই ছিলো মূল দুর্বলতা। ব্রিটিশ সরকার এই দুর্বলতাকে ভিত্তি করে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে দমননীতি গ্রহণ করে। আগস্ট প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় ৮ আগস্ট। তার পরদিনই ৯ আগস্ট ব্রিটিশ সরকার গান্ধীসহ কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে।

আরো পড়ুন:  ভারতীয় দর্শন হচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম দর্শনের মধ্যে অন্যতম

কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারে দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্নস্থানে আন্দোলন জঙ্গী এবং ধ্বংসাত্মক আকার গ্রহণ করে। রেল লাইন, টেলিগ্রাফ তার এবং শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্দোলনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। মেদিনীপুরের একটি অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা অস্বীকার করে স্বাধীন সরকার স্থাপন করা হয়। কিন্তু এ সমস্ত কার্যক্রম খুব সংগঠিত ছির না। কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয় নি। অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী বর্বর সাম্প্রদায়িক গান্ধী তখন কারাগারে আবদ্ধ। বিচ্ছিন্ন এবং নেতৃত্বহীন এরূপ স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারের সামরিক এবং নির্মম দমনের মুখে অধিক দিন স্থায়ী হতে পারে নি। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই এ আন্দোলন দমিত হয়ে যায়। আগস্ট ৯ এবং ডিসেম্বর ৩১-এর মধ্যে ৬০ হাজারের অধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়; ১৮০০০ রাজনীতিক কর্মীকে ভারত রক্ষা আইনে আটক রাখা হয়; পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর গুলি বর্ষণে প্রায় এক হাজার নিহত হয়।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৬৯-৭০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!