শক্তির ভারসাম্য হচ্ছে একটি দেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত কৌশলের ব্যাপার

শক্তির ভারসাম্য বা ক্ষমতার ভারসাম্য (ইংরেজি: Balance of Power) হচ্ছে একটি দেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত কৌশলের ব্যাপার। একটি রাষ্ট্র যদি তার বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এরূপ কৌশল অবলম্বন করে কিংবা করার চেষ্টা করে যাতে তার নিজের রাজনীতিক, অর্থনীতিক এবং সামরিক শক্তিকে আর কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগোষ্ঠীয় অনুরূপ শক্তি অতিক্রম করে যেতে না পারে তা হলে এই কৌশলকে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল বলা হয়।[১]

শক্তিসাম্য বজায় রাখার জন্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ যাতে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই অনেক রাষ্ট্র যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে বিসমার্কের নেতৃত্বে প্রাশিয়া যখন সাত সপ্তাহের মধ্যে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে তখন ইউরােপের শক্তিসাম্য হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ইউরােপে প্রাশিয়ার শক্তি খুব বদ্ধি পায় এবং তাই তুলনামূলক বিচারে ফ্রান্সের শক্তি হ্রাস পেল। ফলে শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। সেই যুদ্ধে অবশ্য ফ্রান্স পরাজিত হয়েছিল।[২]

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার ইউরোপের ক্ষেত্রে শক্তির ভারসাম্য নামক কূটনীতিক কৌশল অনুসরণ করে চলছিল। ইউরোপে তখন একদিকে ছিল জার্মানি, অষ্ট্রিয়া এবং ইতালির ত্রয়ী-জোট এবং অপর দিকে ছিল ইংরেজ, ফরাসি এবং রাশিয়ার ত্রয়ী-জোটের শক্তি। এই দুই জোটের পারস্পারিক লক্ষ্য ছিল যেন প্রতিপক্ষ তাকে অতিক্রম করে যেতে না পারে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ইউরোপে জার্মানি যখন ক্রমান্বয়ে পররাজ্য গ্রাস করে নিজ পক্ষের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে তখন ইংল্যাণ্ড তার পাল্টা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম হয়। এই পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার নাজিবাদী জার্মানির প্রতি তোষণনীতি অবলম্বন করে।

বস্তুত প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্রমে বিরাট রুশদেশে পুঁজিবাদের প্রতি-ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা পুরাতন ভারসাম্যব্যবস্থাকে পুঁজিবাদী যে কোনো রাষ্ট্রের নিকট অপ্রয়োজনীয় এবং অকেজো করে তোলে। তখন থেকে পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে ভারসাম্যের প্রশ্নটির সূচনা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত পুঁজিবাদী ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রসমূহের বিশ্বাস ছিল যে, সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থা ও শক্তি দীর্ঘজীবি হবে না। তারা সমাজতন্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বিষ্ময়কর বিজয়, অধিকতর দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং জার্মানির মতো দুর্ধর্ষ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পরাজয় এই বিশ্বাসকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে।

আরো পড়ুন:  গণহত্যা বা নরসংহার ও গণপ্রজ্বালন বলতে কি বুঝায়

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের প্রধান শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে প্রধান প্রতিপক্ষ বলে গণ্য করে তার সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পারস্পারিক শক্তির সমতা বুঝায়। যদিও নব্বই-এর দশকের গোড়াতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রাধান্য সৃষ্টির পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে এবং এই পরিস্থিতি সিরীয় গৃহযুদ্ধের আগে পর্যন্ত বলবত থাকে।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৭৬।
২. গৌরীপদ ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ডিসেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ১৮১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!