যাঁরা ইতিহাস ও ভূগোলের বিষম সম্পর্ক নিয়ে সচরাচর মাথা ঘামান না, তাঁদের জন্য এ তথ্য জানাচ্ছি, ভারতের উত্তর-পূর্বের সবচেয়ে বড় রাজ্য আসামে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সবাই অসমিয়া নন। না, তা আদপেই নয়। এখানে অসমিয়াদের সঙ্গে আছে প্রচুর বাঙালি, হিন্দিভাষী, বড় জনগোষ্ঠী, ডিমাসা-কার্বি-মিশিং-আহোম-মৈতৈ-মণিপুরি-বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি-মারা প্রভৃতি ক্ষুদ্র জনসমাজ। এদের সবাইকে সহাবস্থানের পাঠ দেওয়ার বদলে দেশভাগ, অর্থাৎ স্বাধীনতার সময় থেকে আধিপত্যবাদী অসমিয়া রাজনৈতিক সমাজ বেপরোয়াভাবে অসমিয়াকরণের নীতি অনুসরণ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিত আগে বুঝে না নিলে ২০১৭-এর বর্ষশেষের মধ্যরাতে আসামের বাঙালির (বিশেষভাবে দক্ষিণ আসামের বাঙালির প্রধান বরাক উপত্যকার মানুষের) সার্বিক বিপন্নতার থই পাওয়া যাবে না।
নতুন বছর ২০১৮ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি ১৪৪ বছর, অর্থাৎ ১৮৭৪ সালে। সে বছর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে পূর্ব প্রান্তিক বঙ্গছাড় জেলা (আজকের বরাক উপত্যকা), সংলগ্ন সিলেট এবং উত্তরের রংপুর জেলার গোয়ালপাড়া মহকুমাকে ছেঁটে নিয়ে ব্রিটিশ জুড়ে দিয়েছিল আসামে। নইলে ওই রাজ্যের রাজস্ব আদায় হচ্ছিল না। আমাদের সর্বনাশের শুরু নিঃশব্দ সেই বঙ্গভঙ্গে। তারপর ১৯০৫ ও ১৯১১ এল এবং গেল। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার সময় কিন্তু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কোনো চক্ষুষ্মান নেতা এই তিন নির্বাসিত জেলার কথা একবারও মনে করলেন না। তারপর সাম্প্রদায়িকতার বিষক্রিয়ার অবিভাজ্য বাঙালিসত্তা দ্বিখণ্ডিত হলো। ভয়ানক আত্মবিস্মৃতিতে সবাই ভুলে গেল ভাষাচার্য সুনীতিকুমার, মহাপণ্ডিত শহীদুল্লাহ্, বিদগ্ধ গবেষক নীহাররঞ্জন এবং রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পাঠ। দেশভাগ-দেশত্যাগের ট্র্যাজেডিতে বহু প্রজন্মের আশ্রয়চ্যুত বাঙালি আশ্রয় নিল তৎকালীন কাছাড়ে, পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়। কাছাড়ের বাঙালিরা ভাষার জন্য আন্দোলন করলেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১০ জন তরুণ ও ১ জন তরুণী শহীদ হলেন মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায়। এরপর ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট একজন এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই দুজন মাতৃভাষার জন্য আত্মদান করেন।
পাশাপাশি তখন আসাম সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রচার করছিলেন, ‘আসাম শুধু অসমিয়ার।’ বাঙালিদের চিরশত্রু হিসেবে ধার্য করে আসামকে বাঙালিশূন্য করার জন্য বারবার সরকারি প্রশ্রয়ে দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে গুয়াহাটি শহরের দাঙ্গায় বহু বাঙালি সর্বস্বান্ত হয়েছে। সেই শুরু। ১৯৬০ সালে দাঙ্গা গণহত্যার রূপ নিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে কাছাড়ে, উত্তরবঙ্গে। ১৯৮৩ সালে নেলি ও গোহপুরের বীভৎস গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্তরে নিন্দিত হয়েছিল। পর্যায়ে পর্যায়ে বঙ্গালখেদা-বিদেশিখেদার উন্মাদ আয়োজনে বিষাক্ত হয়েছে আসামের পরিমণ্ডল। কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আসাম চুক্তি করে। ধাপে ধাপে উগ্র অসমিয়া আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো বন্ধ করেছে, বাঙালি ছেলেমেয়েদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করেছে, সরকারি আধিকারিকদের মধ্যে বাঙালির উপস্থিতি শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সংঘবদ্ধভাবে ভুল তথ্য ও মিথ্যা যুক্তি দিয়ে বহির্ভারতের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, আমজনতাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে; আসাম বাঙালিরা (থুড়ি বাংলাদেশিরা) দখল করে ফেলছে। অথচ সত্য পুরো বিপরীত। বাঙালি জাতির প্রতি বদ্ধমূল ঘৃণা ও বিদ্বেষকে গত তিন বছরে উসকে দিয়েছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান।
তাই বাঙালির শত্রু ঘরে ও বাইরে। একদিকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষে যুক্তিহীনভাবে বিভাজিত হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালি। এবং সেই বিভাজনের শক্তিতে বলীয়ান বাঙালিবিদ্বেষী অসমিয়া আধিপত্যবাদের সন্ত্রাস। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে যে নাগরিকপঞ্জির খসড়া প্রকাশিত হলো বর্ষশেষের মধ্যরাতে, তাতে এই কলাম লেখক সপরিবার অনুপস্থিত। অথচ আমার বাবা তারাপদ ভট্টাচার্য স্বাধীনতাসংগ্রামী, ভারত সরকারের তাম্রপত্র প্রাপক এবং তিরিশের দশক থেকে শিলচরের বাসিন্দা। এমনকি ১৯৬২ সালে তিনি আসাম বিধানসভায় নির্বাচিতও হয়েছিলেন। আর আমিও গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনটি বিষয়ে এমএতে প্রথম হয়েছি। ২০০৭ থেকে ২০১২ অবধি আসাম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও ছিলাম। আমার নিয়োগকর্তা স্বয়ং ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাহলে আমি এবং আমার পরিবারের সব সদস্য নাগরিক নই কেন? বাঙালি বলে?
কেন, বাঙালিমাত্রই কেন ‘বাংলাদেশি’ উগ্র অসমিয়া আধিপত্যবাদীদের কাছে? বাংলাদেশি শব্দটা কি গালাগাল? যদি তা-ই হবে, রাষ্ট্রীয় স্তরে ভারত ও বাংলাদেশ ভালো বন্ধু হয় কেন? এই যদি হয় রাজ্যশাসকের মনোভাব, তাহলে ঢাকা ও গুয়াহাটির মধ্যে বিমান চলাচল বা যানবাহন চলাচলের কথা ভাবা হয় কেন? শুধু আমি নই, এখানকার দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী তৈমুর রাজা চৌধুরীর নামও (যিনি বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা কমিটির সভাপতিও) খসড়াপঞ্জিতে নেই। নেই শিলচর মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ দেবিদাস দত্ত, বিখ্যাত লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সঞ্জীব দেবলস্কর (যাঁর পরিবার ১৫০ বছর ধরে এখানে রয়েছে), বিখ্যাত চিকিৎসক ধ্রুবজ্যোতি পাল, অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক বিভাস চৌধুরীদের নামও। কত নাম লিখব? নাগরিকপঞ্জির নামে প্রহসন হয়েছে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য অসমিয়া আগ্রাসনবাদীদের সাত দশক ব্যাপ্ত চক্রান্ত সফল করা। এ জন্য পাসপোর্ট প্যানকার্ডসহ সব সরকারি নথিপত্র পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছে এবং তাদের অগস্ত্যযাত্রা হয়েছে। কেন বাঙালিদের এত উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো? এ কি তবে প্রভুশক্তির মর্ষকামী আকাঙ্ক্ষা। ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না।
ভারতের সংবিধানে বাংলা ভাষা শুধু স্বীকৃতই নয়, এ আমাদের জাতীয় সংগীতের ভাষা। এ ভাষায় কথা বলি আমরা। এই অপরাধে কেন আমাদের রোহিঙ্গার মতো ভাসমান জনগোষ্ঠী করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে? ভাবিনি এমন মুহূর্তও আসবে জীবনে। দুঃস্বপ্নের এই প্রহরে তবু রয়েছি অরুণোদয়ের ভরসায়। মানবতাবোধ অবশিষ্ট আছে কোথাও, এই প্রত্যাশায় নিজেকেই বলছি, ‘এখনই অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা!’
তপোধীর ভট্টাচার্য একজন লেখক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯। অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে “প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব”, “পশ্চিমের জানালা”, “রোলাঁ বার্ত তাঁর পাঠকৃতি”, “টেরি ঈগলটন তাঁর তত্ত্বজিজ্ঞাসা”, “মিশেল ফুকো তারঁ তত্ত্ববিশ্ব”, “জাঁ বদ্রিলার সময়ের চিহ্নায়ন”, “জাক দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ” প্রভৃতি।