সংস্কৃতিবান ইউরোপীয় ও বন্য এশীয়

জার্মান শ্রমিক সংবাদপত্রে সুপরিচিত ইংরেজ সোশ্যাল-ডেমোক্রাট রতস্তেইন বৃটিশ ভারতের একটি অতি শিক্ষাপ্রদ ও টিপিক্যাল ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তাতে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ ভারতে বিপ্লবের দ্রুত বিকাশের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সেটা বড়ো বড়ো নিবন্ধের চেয়ে অনেক ফলপ্রদ।

ভারতের অন্যতম প্রদেশের একটি বৃহৎ শহর রেঙ্গুনে (জনসংখ্যা ২ লক্ষেরও বেশি) ইংরেজ সাংবাদিক আর্নল্ড একটি পত্রিকা চালান। তাতে তিনি ‘বৃটিশ বিচারের প্রহসন’ নামে একটি প্রবন্ধে এ্যানড্রু নামে জনৈক স্থানীয় জজের স্বরূপ উঘাটন করেন। প্রবন্ধটির জন্য আর্নল্ড বারো মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, কিন্তু লণ্ডনে তাঁর ধরাধরি করার মতো লোক থাকায় তিনি আপীল করেন এবং ইংল্যাণ্ডের উচ্চতম আদালতের সামনে তাঁর মামলা হাজির হয়। ভারত সরকার তখন তাড়াতাড়ি দণ্ড হ্রাস করে চার মাস করেন এবং আর্নল্ড মুক্তি পান।

ঘটনাটা কী ঘটেছিল?

বৃটিশ পল্টনের কর্ণেল ম্যাক-করমিকের প্রেমিকার ১১ বছরের একটি ভারতীয় দাসী ছিল আন্না নামে। সংস্কৃতিবান এক জাতির উদার প্রতিনিধি ম্যাক-করমিক আন্নাকে ফুসলিয়ে নিজের ঘরে ডেকে আনে, এবং বলাৎকার করে তাকে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখে।

আন্নার বাপ তখন মারা যাচ্ছিলেন, মেয়েটিকে তিনি দেখতে চান। গাঁয়ের লোক তখন টের পায় কী ঘটেছে এবং ক্ষেপে ওঠে। তখন ম্যাক-করমিককে গ্রেপ্তারের আদেশ না দিয়ে পুলিসের আর কোনো উপায় থাকে না।

কিন্তু জজ সায়েব এ্যান্ড্র, তাকে জামিনে খালাস দেয় এবং পরে বিচারের অতি লজ্জাকর এক প্রহসন-ধারার পর নির্দোষী বলে রায় দেয়! এই অবস্থায় অভিজাত কুলের এই সব বাবুরা যা করে থাকে, উদার কর্ণেলটিও তাই করে। দাবি করে যে আন্না বেশ্যা এবং তা প্রমাণের জন্য পাঁচটি সাক্ষীও হাজির করায়। কিন্তু আন্নার মা যে আটজন সাক্ষীর নাম করেছিলেন, জজ সায়েব তাদের সাক্ষ্য নিতেও অস্বীকার করে।

মানহানির অভিযোগে সাংবাদিক আর্নল্ডের যখন বিচার হয়, তখন প্রধান বিচারক ‘স্যার’(!) চার্লস ফক্স তাঁর পক্ষে সাক্ষী হাজির করার অনুমতি দেননি।

আরো পড়ুন:  নারী শ্রমিকদের প্রতি

পরিষ্কার বুঝা যায় যে এই ধরনের হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ ঘটনা ভারতে আছে। অতি ব্যতিক্রমমূলক এক অবস্থার ফলেই মানহানিকারক আর্নল্ড (তাঁর পিতা লণ্ডনের এক প্রভাবশালী সাংবাদিক!) কারাদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পান এবং মামলাটি লোক-গোচরে আসে।

এও ভোলা উচিত নয় যে ইংরেজ উদারনীতিকেরা তাদের ‘সেরা’ লোকেদের পাঠায় ভারত-শাসনের ভার দিয়ে। কিছুদিন আগে ভারতের বড়োলাট, এই সব ম্যাক-করমিক, এ্যানড্রু ও ফক্সদের কর্তা ছিলেন জন মর্লি, র‍্যাডিক্যাল-পন্থী লেখক হিসাবে যিনি সুবিদিত এবং সমস্ত ইউরোপীয় ও রুশীয় উদারনীতিকদের চোখে যিনি ইউরোপীয় জ্ঞানজগতের তারকা ও এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।

এশিয়ায় ইতিমধ্যেই ‘ইউরোপীয়’ প্রেরণা জেগে উঠেছে – এশিয়ার জনগণ হয়ে উঠছে গণতন্ত্র-সচেতন।

‘প্রাভদা’, ৮৭ সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল, ১৯১৩
ভ ই. লেনিন,
রচনাবলী ৪র্থ রশ সংস্করণের পাঠ থেকে অনুদিত
১৯শ খণ্ড, ৩৭-৩৮ পঃ

Leave a Comment

error: Content is protected !!