গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের (চৈনিক: 中国 অর্থাৎ “মধ্যদেশ”, ম্যান্ডারিন উচ্চারণে: চুংকুও) মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা রয়েছে। চীন হচ্ছে পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র যেখানে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৯ সালে গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে এবং চীনের মূল ভূখণ্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার অধিকারী বর্তমান চীন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল এবং আয়তনের দিক থেকে এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। এর আয়তন প্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান।[১]

১৯১১ সালে মাঞ্চুশাসনের পতনের পর থেকে সামন্তপ্রভুদের স্বেচ্ছাচার, শোষণ, বিদেশি লুণ্ঠন ও নিপীড়ন, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও বিপ্লবী লড়াইয়ের প্রতিক্রিয়া গোটা দেশকে এক ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্যে এনে দাঁড় করায়। রাস্তাঘাট ভাঙা, সেচব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন, পয়ঃপ্রণালি অকেজো। তার সাথে যুদ্ধে আঘাতের ফলে গোটা দেশ শ্মশানের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে চীনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির উপর দাঁড়ানো এক রিক্ত দেশ হিসেবে। ৫টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ও ৩টি পৌর এলাকা সম্বলিত ২২টি প্রদেশের বিশাল দেশ চীনে শুরু হলও এক মহাযাত্রা। বিশ্ব ইতিহাসে এমন দুর্দশা থেকে মাও সেতুং-এর চীনের এমন মাথা তুলে দাঁড়ানোর উদাহরণ আর একটিও নেই।

১৯৪৯ পূর্ববর্তীকালে বিশাল দেশের বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে চীন দীর্ঘ একটানা পশ্চাৎপদতার মাঝখানে পৃথিবীর মধ্যে একটি অন্যতম সমস্যাসংকুল দেশ হয়ে টিকে ছিল। মোট ছাপান্নটি অগ্রসর, অনগ্রসর জাতি সম্বলিত চীনের বিপ্লবপূর্ব অর্থনীতি ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত। গোটা চীন অতীতে একটি কেন্দ্রীয় শাসনে থাকেনি কখনো। একাধিক সাম্রাজ্যবাদ দীর্ঘ সময় জুড়ে চীনের কোনো না কোনো অংশ দখল করে থেকেছে। ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পরই প্রথম চীনে কোনো বিদেশি সৈন্য, বিদেশি ব্যারাক, বিদেশি পরিদর্শক থাকল না। থাকল না কোনো বৈষম্যমূলক চুক্তি। মূল ভূখণ্ড হলও সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবমুক্ত।

বর্তমান চীনে বিশ্বের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের বাস। এদের শতকরা নব্বই-এরও বেশি হল চৈনিক হান জাতির লোক। হান জাতি বাদে চীনে আরও ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতির বাস। এদের মধ্যে আছে তিব্বতি, মঙ্গোল, উইঘুর, ছুয়াং, মিয়াও, য়ি এবং আরও অনেক ছোট ছোট জাতি। হান জাতির লোকদের মধ্যেও অঞ্চলভেদে ভাষাগত পার্থক্য দেখা যায়। যদিও শিক্ষাব্যবস্থায় ও গণমাধ্যমে পুতোংহুয়া নামের একটি সাধারণ ভাষা ব্যবহার করা হয়, আঞ্চলিক কথ্য ভাষাগুলি প্রায়শই পরস্পর বোধগম্য নয়। তবে চিত্রলিপিভিত্তিক লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করে বলে সব চীনা উপভাষাই একই ভাবে লেখা যায়; এর ফলে গোটা চীন জুড়ে যোগাযোগ সহজ হয়েছে।

ইউরোপীয় শক্তিগুলি পূর্ব এশিয়ায় আগমন করলে চীনের রাজনৈতিক শক্তি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের একটি ক্ষুদ্র প্রশাসনিক অঞ্চল মাকাও মধ্য-১৬শ শতকে পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণে এবং কাছেই অবস্থিত হংকং ১৮৪০-এর দশকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯শ শতকে অভ্যন্তরীণ বিপ্লব এবং বিদেশী হস্তক্ষেপের ফলে চীনের শেষ রাজবংশ কিং রাজবংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯১১ সালে চীনা জাতীয়তাবাদীরা শেষ পর্যন্ত এই রাজতন্ত্রের পতন ঘটায়। পরবর্তী বেশ কিছু দশক ধরে একাধিক সামরিক নেতার অন্তর্কোন্দল, জাপানি আক্রমণ, এবং সাম্যবাদী ও কুওমিনতাঙের জাতীয়তাবাদী সরকারের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ দেশটিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর আগে ১৯২৮ সালে জাতীয়তাবাদীরা প্রজাতান্ত্রিক চীন প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর চীনের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনাধীন সরকার কৃষি ও শিল্পব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অধীনে নিয়ে আসে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ থেকে সরকার অবশ্য অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করে যাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের আরও সংস্কারের ফলে চীনা অর্থনীতি ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বছরে ১০% হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে ২১শ শতকের শুরুতে এসে চীনা অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়।

১৯৯৭ সালে ব্রিটেন চীনের কাছে থেকে হংকং হস্তান্তর করে, তবে অঞ্চলটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছে। ১৯৭০-এর দশকের শেষে এসে পর্তুগাল মাকাওকে চীনের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৯৯ সালে অঞ্চলটি চীনের কাছে হস্তান্তর করে; মাকাওকেও বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়।

চীনের এই পরিবর্তন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল। চীনের পরিবর্তনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যা ১৯২১ সালের ১ জুলাই, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সহায়তায় প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে পার্টির সংবিধান গৃহীত হয় এবং রুশ বলশেভিক পার্টির ধরনে এক নতুন বিপ্লবী পার্টি হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালের জুলাই মাসে সাংহাইতে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব প্রয়োগের সাহায্যে, কংগ্রেস সঠিকভাবে চীন বিপ্লবের কর্মসূচি সংক্রান্ত সমস্যাবলীকে আলোচনা করে। এই কংগ্রেস কর্তৃক প্রকাসিত ইশতেহারে চীনা বিপ্লব সংক্রান্ত সমস্যাবলী সম্পর্কে পার্টির পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়। পার্টি গঠনের পর থেকেই চীনা শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের জাগরণ ঘটে। হুনানে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন চলে ১৯২২-২৩ সালে। পিকিং-হ্যাঙ্কাও রেল শ্রমিকদের বৃহৎ রাজনৈতিক ধর্মঘটের মাধ্যমে চীনে ধর্মঘট ও আন্দোলনের নতুন মাত্রা শুরু হয়। ১৯২৩ সালের জুন মাসে ক্যান্টনে পার্টির তৃতীয় জাতীয় কংগ্রেসে জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কমিউনিস্ট পার্টি ও কুওমিনতাংয়ের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বৈপ্লবিক সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে বিপ্লবী সম্মিলিত ফ্রন্টের মাধ্যমে বিপ্লবী আন্দোলনের উত্থান ঘটে। ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে তুঙ্গ গণআন্দোলনের সময় পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস সাংহাইতে অনুষ্ঠিত হয়।

১৯২৬ সালের মার্চ মাসে মাও সেতুং লিখলেন ‘চীনা সমাজের শ্রেণি বিশ্লেষণ’। উপনিবেশসমূহে জাতীয় বিপ্লব সম্পর্কে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব এবং লেনিনবাদী মতাদর্শ ও কর্মপন্থার উপর নিজেকে দাঁড় করিয়ে মাও সেতুং নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মৌলিক ভাবধারা, প্রলেতারিয়েত নেতৃত্বে এবং শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে আপামর জনসাধারণের বিপ্লবের তত্ত্ব সর্বসমক্ষে উপস্থাপিত করেন। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে হুনানে ৫০টিরও বেশি জায়গায় ১৩,৬৭,০০০ সদস্য সম্বলিত কৃষক সমিতি গঠিত হয়। দশ লক্ষাধিক সদস্যের কৃষক সমিতিকে মেরুদণ্ড করে এক কোটিরও বেশি কৃষকের সাহায্যে হুনানে কয়েক মাসের মধ্যে বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবীদের মধ্যে কৃষক সমস্যা নিয়ে প্রচণ্ড দুনিয়া কাঁপানো সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯২৭ সালের ২৭ এপ্রিল ৮০ জন প্রতিনিধি নিয়ে হ্যাঙ্কাওতে পার্টির পঞ্চম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস সমগ্র পার্টির সামনে দুটি করণীয় কাজ উপস্থাপিত করে: কৃষি বিপ্লব সম্পন্ন করা এবং জনগণের রাজ কায়েম করা। পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯২৪-২৭ সালের যুদ্ধ হলও চীনা জনগণের প্রথম সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী যুদ্ধ।

১৯২৭ সালের অক্টোবরে মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে শরৎকালীন ফসল তোলার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা হুনান-কিয়াংসী সীমান্তে অবস্থিত চিংকাং পর্বতমালা অভিমুখে ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করে এবং এখানেই প্রথম বিপ্লবী ঘাঁটি স্থাপিত হয়। ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩০ সালের প্রারম্ভে, তিন বছর সংগ্রামের পর, বিপ্লবী ঘাঁটি, সশস্ত্র গণবাহিনী যা চীনা শ্রমিক-কৃষকের লাল ফৌজ তা বহু এলাকায় গঠিত হয়।

১৯৩০’র প্রথম দিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অভূতপূর্ব আকারে দেখা দেয়; আর জাপ-সেনাবাহিনী ১৯৩১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শেনিয়াঙের উপর আক্রমণ শুরু করে। জাপ-সাম্রাজ্যবাদীরা উত্তর-পূর্ব চীন দখল করে। চিয়াং কাইশেকের বাহিনীও লাল ফৌজকে আক্রমণ করতে তার বাহিনী কেন্দ্রীভূত করে। চিয়াং কাইশেকের আবেষ্টনী জোর করে ভাঙার উদ্দেশ্যে এবং নতুন জয়লাভের আশায়, চীনা শ্রমিক-কৃষকের লাল ফৌজ ১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসে লং মার্চ নামে অভিহিত দুনিয়া কাঁপানো পরিবর্তিত রণনীতি কার্যকরী করতে শুরু করে। ১৯৩৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১২ মাসে কেন্দ্রীয় লালফৌজ ১১টি প্রদেশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, শত্রুর আবেষ্টন, পশ্চাদ্ধাবন, বাধাসৃষ্টি ও পথিমধ্যে অবরোধ চূর্ণ করে, লালফৌজ ১২,৫০০ কিমি পথ অতিক্রম করে, অসংখ্য সামরিক ও রাজনৈতিক অসুবিধা ও প্রাকৃতিক বাধা কাটিয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত উত্তর শেনসী বিপ্লবী ঘাঁটিতে পৌঁছায় এবং বিজয় গৌরবে সেখানকার লালফৌজের সংগে মিলিত হয়। মাও সেতুং ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর নিম্নোক্ত ভাষায় প্রতিবেদন দাখিল করলেন,

“ইতিহাসে লং মার্চের মতো ঘটনা এই প্রথম, এটি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রকাশ্য ইশতেহার, আন্দোলন সংগঠনকারী বাহিনী ও বীজ উৎপাদনকারী যন্ত্র বিশেষ।”[২]

১৯৩৫ সালে সাম্রাজ্যবাদী জাপান উত্তর চীন নতুন করে আক্রমণ করে। চীন দখলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জাপানের মধ্যে সংগ্রাম জোরদার হয়। সেই বছরের ৯ ও ১৬ ডিসেম্বর কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছাত্ররা জাপ-প্রতিরোধ ও চীন বাঁচাও আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কৃষক শ্রমিকদের সংগে যোগাযোগ করে। পার্টি কর্তৃক জাপ-বিরোধী জাতীয় যুক্তফ্রন্টের কৌশল গ্রহণ করা হয়। ১৯৩৫ সালের শেষে গৃহযুদ্ধের প্রায় সমাপ্তি ঘটে জাপ-বিরোধী যুদ্ধে পরিবর্তিত হয়।  

১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই জাপানি ফ্যাসিস্ত সৈন্যরা পিকিং-এর ১০ কিমি দক্ষিণে আক্রমণ শুরু করে। ১৫ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কমিউনিস্ট পার্টি ও কুয়োমিনতাং-এর মধ্যে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রচার করে। প্রতিরোধাত্মক জাতীয় যুদ্ধকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন করে। ১৯৩৭ সালের ২১ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের সংগে অনাক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং ঘোষণা করে যে দুটি দেশের সম্পর্কের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধনীতি অনুসরণ করা হবে না এবং চীন কোনো তৃতীয় শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই আক্রমণকারী দেশকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্যদানে বিরত থাকবে।

দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দেশ থেকে শেষ নাৎসি আক্রমণকারীকে হটিয়ে দেয়। নাৎসি জার্মানির পরাজয় ফ্যাসিবাদী ব্লককে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়। ১৯৪৫ সালের ২৩ এপ্রিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হয়। মাও সেতুং তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যে বলেন,

“আমাদের কর্মনীতির মূলকথাই হচ্ছে নির্ভীকভাবে জনগণকে সমবেত করা, জনগণের শক্তিগুলোকে সম্প্রসারিত করা যাতে করে আমাদের পার্টির নেতৃত্বাধীনে তারা আক্রমণকারীদের পরাজিত করতে পারবে এবং নতুন একটি চিন গড়ে তুলবে।”।[৩]

‘মুক্তাঞ্চলের রণাঙ্গন’ শিরোনামে কমরেড চু তে কংগ্রেসে সামরিক প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবেদনে সবিস্তারে প্রকাশ করা হয়েছে গণবাহিনীর সাফল্যজনক সামরিক কর্মপন্থা, জনযুদ্ধ এবং বিপ্লবী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পার্টি ১৭ বছর ধরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, সেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এবং ও কমরেড মাও সেতুং-এর সামরিক তত্ত্বের ভিত্তিতে রচিত চীনা জনগণের জাপ-বিরোধী যুদ্ধের বিষয়াবলী। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চীনের জনগণ বিজয়লাভ করে। চীনা জনগণ ও সোভিয়েত জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব, মৈত্রী এবং পরস্পর সহযোগিতা গড়ে উঠায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।

১৯৪৬ সালে চিয়াং কাইশেক চক্র বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে জনগণের মুক্তাঞ্চলের উপর দেশব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। প্রতিটি রণাঙ্গনে কুয়োমিন্টাং সৈন্যদের পরাজয় ঘটে এবং কুয়োমিন্টাং নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল আরো বেশি মাত্রায় উপনিবেশে পরিণত হয়। ১০ অক্টোবর চীনা গণমুক্তিফৌজ ধ্বনি তোলে ‘চিয়াং কাইশেক নিপাত যাক। সমগ্র দেশকে মুক্ত কর’। ১৯৪৭ সালে তিনটি বিরাট অভিযানের মাধ্যমে সমগ্র দেশে জনগণের বিপ্লবী যুদ্ধের মৌলিক বিজয় সাধিত হয়। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে নব রাষ্ট্রের উদ্বোধন হয়। চেয়ারম্যান মাও সেতুং কর্তৃক সমগ্র বিশ্বের নিকট এক বার্তায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও কেন্দ্রীয় গণসরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকেই চীনের ইতিহাস সমাজতন্ত্রে উত্তরণের নীতি ও কর্মপন্থা গ্রহণের মাধ্যমে নতুন যুগে পদার্পণ করে।[৪]

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ

১. বাংলা উইকিপিডিয়া,
২. মাও সেতুং, নির্বাচিত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা, অক্টোবর, ১৯৯২, পৃষ্ঠা-১৬২।
৩. মাও নির্বাচিত রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, নবজাতক প্রকাশন, কলকাতা, অক্টোবর, ২০০১, পৃষ্ঠা-২৯১।
৪. এই লেখাটিতে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রন্থ (ক) হো কান-চি, আধুনিক চীন বিপ্লবের ইতিহাস, দ্বিজেন গুপ্ত অনূদিত, র‍্যাডিক্যাল, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১১ এবং (খ) সমীরণ মজুমদার, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১০। প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লেখা ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ১০৬-১১২ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!