মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ

লেনিন লিখেছিলেন : “সারা ইউরোপ থেকে সামান্য ছোট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থব্যবস্থার ব্যাপক বৈচিত্র্য প্রধান বিভাগগুলির পৃথক পর্যালোচনাকে একান্তই অপরিহার্য করে তোলে। লেনিনের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো তিনটি ভাগে বিভক্ত: শিল্পপ্রধান উত্তর, প্রাক্তন দাসপ্রথাধীন দক্ষিণ এবং নতুন বসতাঞ্চল পশ্চিম।

গত অর্ধশতকের ব্যাপক রদবদল সত্ত্বেও অর্থনীতির এই বৈশিষ্ট্য এবং বিন্যাস আজও টিকে আছে। একপক্ষে উত্তরের শক্তিশালী এবং অন্যপক্ষে দক্ষিণ ও পশ্চিমের ফিনান্সকারী ও শিল্পপতিদের যৌথসংস্থাগুলি —এই দু’য়ের তীব্র দ্বন্দ্ব দেশের অর্থনীতির বিকাশের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এখনো যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

অতীতের মতো আজও উত্তর অর্থনৈতিক দিক থেকে মার্কিন দেশের প্রধান ও উন্নততম অঞ্চল। দেশের এক-চতুর্থাংশ এলাকা, অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা এবং দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ ও শিল্পসামর্থ্য আজ উত্তরভুক্ত। তদুপরি সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক বাজারজাত ফসলেরও উৎপাদক।

উত্তরের শিল্পসমাহারে মানুফ্যাকচারিং শিল্প, বিশেষত ইঞ্জিনিয়রিংই অগ্রগণ্য। মোট ইস্পাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি এবং প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উত্তর উৎপাদন করে। সেখানকার কৃষিক্ষেত্রের মুখ্য বিভাগগুলির মধ্যে গরুপ্রজনন (মাংস এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী), পশুখাদ্য উৎপাদন (দেশে উৎপাদিত ভুট্টার ৮০ শতাংশ), গম ও শাকসব্জি উল্লেখ্য। মার্কিন দেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৬৬ শতাংশ উত্তরেরই আওতাধীন।

অর্থনৈতিক দিক থেকে উত্তর দুটি উপাঞ্চলে বিভক্ত: শিল্পপ্রধান পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র।শিল্পপ্রধান পূর্বে (নিউ ইংলণ্ড, মধ্য আটলান্টিক রাজ্যসমূহ ও গ্রেট লেক অঞ্চল) উত্তরের অর্ধেকের চেয়ে কম এলাকা থাকা সত্ত্বেও সেখানে সারা অঞ্চলের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বসবাস করে এবং ৯০ শতাংশের বেশি শিল্পপণ্য উৎপন্ন হয়।

পূর্ব উপাঞ্চলেই দেশের প্রধান শিল্পনগরগুলি অবস্থিত। আটলান্টিকতীরে রয়েছে বিশাল শিল্পকেন্দ্র নিউ ইয়র্ক (শহরতলী সহ জনসংখ্যা ১ কোটি ৬০ লক্ষ) সমুদ্রবন্দর, রেলপথ, হাইওয়ে ও বিমান টার্মিনাল। এখানকার কর্মরত জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বাণিজ্য ও ফিনান্সের ক্ষেত্রে নিয়োজিত। তারপরই শিকাগো (শহরতলী সহ জনসংখ্যা ৭০ লক্ষ) উল্লেখ্য। এটি গ্রেট লেক এলাকার খুবই গুরত্বপূর্ণ শিল্প, বাণিজ্য ও ফিনান্স কেন্দ্র। শিকাগোর লৌহ ও ইস্পাত শিল্প বার্ষিক ৩ কোটি টন পর্যন্ত ইস্পাত উৎপাদন করে। শহরের ইঞ্জিনিয়রিং কারখানাগুলিতে শক্তিশালী রেলইঞ্জিন থেকে শুরু করে সক্ষম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সহ বহুধরনের সামগ্রী তৈরি হয়। মাংস-প্যাকিং সংস্থাগুলি সহ এখানকার গরুর বাজার বিশ্বখ্যাত। পূর্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে নিউ ইংলণ্ডের শিল্পকেন্দ্র বোস্টন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর ও বিশাল শিল্পকেন্দ্র ফিলাডেলফিয়া এবং ধাতুশিল্প, রকেট-নির্মাণ ও জাহাজ তৈরির কেন্দ্র বাল্টিমোর উল্লেখ্য।

আরো পড়ুন:  আমেরিকার সভ্যতা হচ্ছে অধিবাসীদের নিজেদের গঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা

গ্রেট লেক এলাকার একটি বৃহৎ শিল্পকেন্দ্র বাফেলো এবং রাসায়নিক, ধাতু ও ইঞ্জিনিয়রিং শিল্প সহ ক্লিভল্যাণ্ড আর মোটর-শিল্পের জন্য প্রখ্যাত ডেট্রয়েট নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অদূরে অবস্থিত। আপালাচিয়ানের ঢাল, এলাকার পিটসবার্গ শহর খনি, লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের একটি ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্র।

উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র হলো পূর্বের শিল্প-কৃষির সম্প্রসারণ। এই উপাঞ্চলটি গ্রেট লেক ও রকি মাউণ্টেনের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এখানে ভুট্টা ও গম চাষ সহ মাংস ও দুধের জন্য গবাদি পশু পালিত হয়। মিনেয়াপলিস, কেনসাস সিটি ও সেন্ট লুইস কৃষিজ কাঁচামাল প্রসেসিং শিল্পের কেন্দ্রস্থল।

উত্তরের প্রায় সমান আয়তনের হলেও দক্ষিণ অর্থনৈতিক বিকাশের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর। দক্ষিণের শিল্পোন্নয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতি। বর্তমানে সেখানে তৈল, গ্যাস, কয়লা, লোহা নিষ্কাশন ছাড়াও মানুফ্যাকচারিং শিল্প গড়ে উঠেছে। দক্ষিণের গুরত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্রগুলির মধ্যে হিউস্টোন (তৈলশোধন), উইচিতা ও ডালেস (বিমান ও রকেট-নির্মাণ) এবং আইকেন, ওক রিজ, পাদুকা, এমারিলো (পারমাণবিক শক্তি) উল্লেখ্য।

দেশকে তৈল, প্রাকৃতিক গ্যাস, লৌহ-আকরিক, কয়লা ও ইউরেনিয়াম সরবরাহক্রমে দক্ষিণ মানুফ্যাকচারিং শিল্পগুলিকে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এটি একটি গুরত্বপূর্ণ কৃষি-অঞ্চল এবং তুলাচাষ, আগাম শাকসবজি, ফল লেবু, উৎপাদনে বিশেষীকৃত।

দেশের রাজধানী ওয়াশিংটন (শহরতলী সহ জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ) উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যবতী কলাম্বিয়া এলাকায় অবস্থিত। রাজধানীর কর্মরত জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই সরকারী সংস্থার এবং এক-তৃতীয়াংশের অধিক সাভির্স-শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের চাকুরে। এখানে বহু কলেজ, গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সংস্কৃতিকেন্দ্র রয়েছে।

দেশের বৃহত্তম অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমের লোকসংখ্যা কম এবং অন্যান্য এলাকার তুলনায় অর্থনৈতিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত। এর বহত্তর অংশই পর্বত ও মরকীর্ণ। নদীর উপত্যকা, সড়কের আশপাশ এবং উপকূলই এখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।

অঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দা অধ্যুষিত প্রশান্ত মহাসগরীয় রাজ্যগুলিই মূলত শিল্প ও কৃষি প্রধান এলাকা। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় এবং সারা পশ্চিমের মধ্যে কালিফোর্নিয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বাধিক উন্নত রাজ্য। রাসায়নিক ও তৈল শিল্পের চেয়ে বিমান ও রকেট নির্মাণেই যুদ্ধোত্তর কালিফোর্নিয়ার যথার্থ শিল্পকাঠামোর চেহারা সুচিহ্নিত। বর্তমানে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদক।

আরো পড়ুন:  আমেরিকার বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে

কালিফোর্নিয়া ও সারা পশ্চিমের বৃহত্তম যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ কেন্দ্র হিসাবে লস এঞ্জেলস (শহরতলী সহ জনসংখ্যা ৭০ লক্ষ) ও সান দিয়েগো সবিশেষ উল্লেখ্য। উত্তরের হানফোর্ডে পারমাণবিক শিল্প অবস্থিত। লস এঞ্জেলসের পর পশ্চিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সান ফ্রান্সিসকো একটি গুরত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দর।

দেশের পর্বতসঙ্কুল পশ্চিমের বিশাল অঞ্চলে মাঝে মাঝে নিষ্কাশনমূলক শিল্প গড়ে উঠেছে। তদুপরি সেখানে আছে জলসেচকৃত খামার এবং বাথানভিত্তিক পশুপালন।

পুনরায় বিভিন্ন জাতির ভাগ্যনিয়ন্তার ভূমিকাসীন হওয়ার ইচ্ছায় মার্কিন শাসকচক্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে থাকে। সারা দুনিয়ার শান্তি ও প্রগতির প্রাচীরকল্প সোভিয়েত ইউনিয়নই তাদের যুদ্ধপ্রস্তুতির লক্ষ্যস্থল। এইসব আক্রমণাত্মক অভিপ্রায় ব্যর্থ করে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য, এই গ্রহে শান্তি মজবুতের লক্ষ্যে সহযোগিতা উন্নয়নের জন্য সর্বদাই আগ্রহ দেখায়।

তথ্যসূত্রঃ

১. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ১৭৪-১৭৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!