গদর পার্টি ছিলো প্রধানত পাঞ্জাবিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বিপ্লবী সংগঠন

গদর পার্টি (ইংরেজি: Gadar Party বা Ghadar Party) প্রধানত পাঞ্জাবিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বিপ্লবী সংগঠন ছিলো। গদর শব্দটির অর্থ হলো বিদ্রোহ। ক্যালিফোর্নিয়ার স্টকটন শহরে বসবাসকারী শিখদের নিয়ে ১৯১৩ সালে দলটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লালা হরদয়াল। প্রবাসে ভারতের জাতীয় স্বাধীনতার প্রচার করা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। শিখদের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা গড়ে তােলার জন্য ‘গদর’ নামে একটি পত্রিকা সেই বছর থেকেই প্রকাশিত হতো। সম্পাদনা করতেন রামচন্দ্র নামে জনৈক পঞ্জাবি।[১]

১৯১১ খ্রীস্টাব্দে সান ফ্রান্সিকো পৌঁছানোর পর অচিরেই হরদয়াল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী ভারতীয়দের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ‘গদর’ (বিদ্রোহ) নামটি ১৮৫৭-১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দের বিদ্রোহের স্মৃতি থেকেই চয়িত হয়েছিল। সেই বছরেই আমেরিকা প্রবাসী বিভিন্ন ভারতীয় সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠিত একটি কংগ্রেসে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন’ নামক যে-সংস্থাটি গঠিত হয়েছিল তারও মূলে ছিলেন হরদয়াল। অচিরেই সংস্থাটিকে ‘গদর’ নাম দেয়া হয়।[২]

আমেরিকা এবং জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়, চীন ইত্যাদি সহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় বহু দেশে এটির শাখা-প্রশাখা জালের মতাে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর সদস্যরা ভারতে অভ্যুত্থান ঘটানাের বহু পরিকল্পনা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলনেতাদের পরিকল্পনা মােতাবেক বিপ্লবীদের কোষকেন্দ্র হিসাবে কাজের জন্য প্রবাসীদের নিয়ে সৈন্যদল গঠন করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে প্রবাসীদের (যাদের কেউ কেউ ছিল খুবই ধনী) কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থে অস্ত্রশস্ত্রও ক্রয় করা হয়েছিল। সাপ্তাহিক সংবাদপত্র গদর এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় মার্কিন প্রবাসী দলনেতাদের প্রকাশিত পুস্তিকাগুলি খােদ ভারতেও প্রচারিত হওয়ার ফলে সেগুলি জনগণের মধ্যে ব্রিটিশবিরােধী মনােভাব গড়ে তােলার পক্ষে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।[২]

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বেআইনি অনুপ্রবেশের দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন পেয়ে তিনি পালিয়ে ইউরােপে চলে যান। জার্মানিতে পরে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত বার্লিন কমিটিতে যােগ দেন।

ভারতে বিদ্রোহ

ভারতে অনুশীলন সমিতি ও গদর পার্টির সহযােগিতায় বিদ্রোহের অংশ হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হয়। সেই পরিকল্পনা অনুসারে সিঙ্গাপুরের বীর সিপাহীগণ ২১শে ফেব্রুয়ারী স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ভারতীয় সৈন্যগণ ইংরেজ সৈন্যদিগকে পরাজিত করিয়া দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সিংগাপুর সহর দখল করে রাখেন। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে অন্য কোথায়ও সামরিক অভ্যুত্থান না হওয়ায় এবং বাহিরের সহিত যােগাযােগ না থাকায় সিংগাপুরের সৈনিকগণ অধিক দিন তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে পারেননি। ইতিমধ্যে বৃটিশ রণতরী ও বৃটিশের মিত্র জাপানের রণতরী এসে পুনরায় অধিকার করে। এই সংগ্রামে বিপ্লবী সৈনিকদিগের অধিকাংশ নিহত হন, কিছু লােক ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করিয়া প্রাণ বিসর্জন দেন, অবশিষ্ট পলায়ন করে ব্রহ্মদেশ ও শামিরাজ্যে চলে যেতে সক্ষম হন।[৩]

আরো পড়ুন:  ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল

মার্কিন দেশে ও কানাডায় গদর পার্টির নেতৃত্বে লালা হরদয়াল ছাড়াও জওলা সিং, সােহন সিং ভাকনা, সন্তোক সিং, গুরমুখ সিং, কেশর সিং, কর্তার সিং, কাসিরাম, রহমত আলি প্রমুখ বিপ্লবীদের কথা জানা যায়। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পক্ষে যােগদানের পর গদর পাটির বহু সদস্য কারারুদ্ধ হন ও তাঁদের বিরুদ্ধে সানফ্রানসিসকো মামলা (১৯১৭-১৮) দায়ের করা হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরােপে গদর পাটি প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের আদর্শ প্রচার করে। প্রথম বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময় সেই আদর্শে প্রভাবিত আনুমানিক আট হাজার ভারতীয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পঞ্জাবে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাসবিহারী বসুর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরা সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছড়ানাের চেষ্টা করেন। অনেকেই গ্রেপ্তার কিংবা অন্তরিন হন। পাঞ্জাব ষড়যন্ত্র মামলায় তিরিশ জনের ফাঁসি হয় ও দ্বীপান্তরিত হন ৫৮ জন।

১৯১৪-১৫ সালের দিকে গদর পার্টির সদস্যরা সিঙ্গাপুর, ইন্দোচীন, ফিলিপাইনস, শ্যাম এবং দূরপ্রাচ্যের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। গুরুদত সিং ছিলেন সিঙ্গাপুরের এক ব্যবসায়ী। তিনি কোমাগাটার নামক একটি ভাড়া-করা জাহাজে ভারত থেকে আড়াইশ শিখ কর্মপ্রার্থীকে নিয়ে কানাডার ভাঙ্কুবারে উপনীত হন। কিন্তু কানাডা সরকার সেখানে তাঁকে অবতরণের অনুমতি না দেওয়ায় জাহাজটি কলকাতায় ফিরে আসে ও বজবজে সেটির আরােহীরা সশস্ত্র বিক্ষোভে লিপ্ত হন। দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৮ সালে বিলুপ্ত হয়।

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮।
২. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৫১৭-৫১৮।
৩. ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, জেলে ত্রিশ বছর, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা, ঢাকা বইমেলা ২০০৪, পৃষ্ঠা ৯৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!