আন্তর্জাতিক আইন (ইংরেজি: International Law) হচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্র পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদে এবং একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে নিজেদের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যে আচরণবিধি প্রণয়ন করে তাকেই আন্তর্জাতিক আইনের বলা হয়। আন্তর্জাতিক আইন দু ধরনের হয়ে থাকে, যথা পাবলিক (অর্থাৎ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে) এবং প্রাইভেট (অর্থাৎ ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে প্রযােজ্য)।
তত্ত্বগতভাবে আন্তর্জাতিক আইনের প্রথম ধরনটি হলো একত্র সুগ্রথিত আইনের যার প্রয়ােগ সর্বদেশীয়। দ্বিতীয়টির প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হলো আইনের অধিক্ষেত্র (jurisdiction) নির্ধারণ এবং দ্বিতীয়ত দেশভেদে আইনের তারতম্য; কার্যত তাই যে দেশে মামলা দায়ের করা হয় সেই দেশেরই আইনে প্রযুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রত্যয়টি ১৭৮০ খ্রি বেনথাম উদ্ভাবন করেন। অবশ্য এ বিষয়ে আধুনিক আলােচনার প্রবর্তন, আরও অনেক পূর্বে অ্যাকুইনাস, গ্রোটিয়াস, কান্ট, পুফেনডর্ফ প্রমুখ রাষ্ট্রদার্শনিকেরা করেছিলেন। তাঁরা সবাই আন্তর্জাতিক অধিক্ষেত্রের তত্ত্বগত ভিত্তি স্থাপনের প্রয়াসী হন। গ্রোটিয়াস স্বাভাবিক আইন (natural law) এবং বাস্তবানুগ আইন (positive law) দুটির মিশ্রণ চাইতেন। পুফেনডর্ফ ছিলেন স্বাভাবিক আইন অনুসরণের প্রবক্তা এবং ভ্যাটেল ছিলেন বাস্তবানুগ আইনের পক্ষপাতী। শেষােক্ত অর্থাৎ বাস্তবানুগ আইনের নিরিখে দুটি বা তদধিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে প্রথা ও চুক্তি হলো আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গত উৎস। স্বাভাবিক নিয়ম অনুসরণের প্রবক্তারা মানবপ্রকৃতির মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস সন্ধানের সুপারিশ করেন।
আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হলো ছ’টি, যথা ১. রােমান আইন, ২. বিজ্ঞানসম্মত প্রামাণ্য বইপত্র, ৩. সন্ধি এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি, ৪. আন্তর্জাতিক আলােচনা সভা এবং বিচার বিভাগের সালিশির রায়, ৫. বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় আইন ও ৬. কূটনৈতিক মতামত বিনিময়। লরেন্স, হল, ওপেনহাইম, গানার প্রমুখ আইনবিদদের গ্রন্থাদি ও বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা আন্তর্জাতিক আইনের বিতর্কে প্রামাণ্য উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রথাগত বিধানের আশ্রয়েও আইনের গড়ে ওঠে।
হ্যারল্ড লাস্কি বলেছেন যে, কোনও একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের যতক্ষণ মান্য ও পালন করে তদবধি তা আইনসিদ্ধ। কিন্তু আজকের দিনে নিজস্ব নিরাপত্তার তাগিদে কোনও রাষ্ট্রই সহসা আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করে না। কারণ নিজ স্বার্থে সব রাষ্ট্রই চায় নিজের নিরাপত্তা ও বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে।
আন্তর্জাতিক আইনের অনুমােদনের প্রধান উৎস হলো জাগ্রত ও শক্তিশালী জনমত। সে জনমত সারা বিশ্বের। আন্তর্জাতিক আইন যাতে কোনও রাষ্ট্র ভঙ্গ না করে সেদিকে সদাই লক্ষ রাখা হলো রাষ্ট্রসংঘের অন্যতম প্রধান কাজ। রাষ্ট্রসংঘের অন্যতম অঙ্গ ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে তাদের সম্মতি সাপেক্ষ কেবল দেওয়ানি বিষয়ের বিরােধে আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাহায্যে মীমাংসা করে।
আইনশাস্ত্রে রাষ্ট্রীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে সম্পর্কসূত্রে তত্ত্বগত নানান প্রশ্ন ওঠে। কারও মতে উভয় আইনকে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত; রাষ্ট্রীয় আইনের উপর আন্তর্জাতিক আইনের প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। অপরদিকে ভিন্ন মতে উভয়ের উৎস স্বতন্ত্র, তবে উভয়ের মধ্যে সংঘাতের পরিবর্তে সামঞ্জস্য বজায় রাখাই কাম্য।
রাষ্ট্রীয় আইনই সর্বাত্মক। সমাজজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই তার আওতায় পড়ে। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক আইনের আন্তরাষ্ট্রিক, সম্পর্কের কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমিত। যুদ্ধ, নিরপেক্ষতা এবং শান্তি আন্তর্জাতিক আইনের প্রধান বিষয়। অন্যান্য বিষয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬।
আরো দেখুন: আইন; আইনশাস্ত্র
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
সহজ কথায় আইন হল কাঠামোগত বিধিবিধান। কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কতগুলো নিয়ম নীতিমালা যখন সকলের জন্য মেনে চলার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে তাকে আইন বলা হয়।
আইন ছাড়া আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র কখনো সঠিকভাবে চলতে পারেনা। কারণ, যে সমাজে বা দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই সেখানে কখনো শৃঙ্খলা টিকে থাকেনা। বিনিময়ে বিভিন্নমূখী সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিকভাবেও আইন হল একাধিক রাষ্টের মধ্যে স্বাক্ষরিত নির্দিষ্ট বিষয়ে মেনে নেওয়া অনুশাসনের কাঠামো। স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের মধ্যে লেনদেন, বানিজ্যিক সম্পর্ক গঠন এবং অন্যান্য কাজে সে আইনসমুহ মেনে পারস্পরিক কাজ করে থাকে।