আন্তর্জাতিক (ইংরেজি: International) হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগঠনের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে গঠিত সংগঠনসমূহের একত্রিত নাম। এই সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা। এই সংগঠনগুলোকে সাধারণত প্রথম আন্তর্জাতিক, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক, তৃতীয় আন্তর্জাতিক ও চতুর্থ আন্তর্জাতিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
প্রথম আন্তর্জাতিকের কার্যক্রম ও ভূমিকা
প্রথম আন্তর্জাতিক ১৮৬৪ খ্রিস্টবাদে লন্ডনে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ওয়ার্কিংমেন’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো শ্রমজীবীদের প্রতি অবিচার ও শােষণ থেকে তাদের রক্ষা করা। তাতে ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, সুইস, পােলিশ প্রতিনিধিরা যােগ দেন। মার্কস সেটির কার্যনির্বাহি সমিতির সদস্য ছিলেন। গঠনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইতালীয় প্রতিনিধি মাৎসিনিকে। ১৮৬৫ খ্রি জেনিভায় সেটির দ্বিতীয় কংগ্রেস বসে। ১৮৬৯ খ্রি পর্যন্ত প্রথম আন্তর্জাতিকের কয়েকটি বার্ষিক অধিবেশন সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়! মার্কস ও এঙ্গেলস সেগুলিতে যােগ দেননি। মিখাইল বাকুনিনের সঙ্গে মতপার্থক্য হেতু ফিলাডেলফিয়ায় সেটির সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বা সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিকের কার্যক্রম ও ভূমিকা
১৮৮৯ খ্রি পারিতে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষির্কী দিবসে দ্বিধারায় বিভক্ত মার্কসীয় ও অ-মার্কসীয় সমাজতন্ত্রীদের সমন্বয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়। সেই থেকে দু তিন বছর অন্তর অনুষ্ঠিত বিশ্ব কংগ্রেসে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল মার্কসীয় মতাদর্শের মূলনীতিগুলি অনুসরণ করে। প্রথম আন্তর্জাতিকে কর্মপদ্ধতি নিয়ে মতভেদ থাকলেও সেটির একটি বৈপ্লবিক প্রবণতা ছিল। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল নানা ধরনের সমাজতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে একটি শিথিল সংগঠনে পরিণত হয়। বিপ্লবের পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক মনােভাব তাতে প্রাধান্য পায়। প্রথম বিশ্ব-মহাযুদ্ধে পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বৈপ্লবিক উত্থানের সুযোেগ না নিয়ে বিভিন্ন দেশের সােসাল ডেমােক্রেটিক পার্টিগুলি নিজ দেশের অনুকূলে দেশানুরাগের মনােভাব নেয়। এই অবস্থায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন লেনিন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক তার বিবর্তনধারায় বিভিন্ন নাম পরিগ্রহ করে। বর্তমানে সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিক নামে সেটি বর্তমান।
সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের কার্যক্রম ও ভূমিকা
১৯১৯ খ্রি মার্চ মাসে বিকল্প তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল হিসেবে ভি আই লেনিন তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (কমিন্টার্ন) গঠন করেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১৯ এ লেনিন (১৮১৭-১৯২৪) এর নেতৃত্বে তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক ১৯৪৩ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে কার্যকর থাকে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের পরে মুক্তি আন্দোলন ও সমাজতন্ত্রের ঢেউ এশিয়া এবং আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়ার চীনদেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাধিত হয় এবং ১৯২১ এ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশেও স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতা ও ব্যাপকতা লাভ করে। ভারতবর্ষের কলকারখানার যে প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল তাতে শ্রমিকশ্রেণীও একটি শক্তিশালী শ্রেণী হিসাবে বিকাশ লাভ করেছিল। ভারতে ১৯৩০ এর দশকে সাম্যবাদী দলের জন্ম হয়। ইউরোপে ইতালী এবং জার্মানীতে কমউনিষ্ট পার্টি বিশেষ শক্তি অর্জন করে।
১৯২০ ও ৩০ এর দশকে ইউরোপে শ্রমিক শ্রেণীর শক্তি বৃদ্ধিতে ও তাদের সংগঠনের আদর্শগত ও সাংগঠনিক জঙ্গীত্বে শাসক শ্রেণী সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে। তার শ্রমিকশ্রেণী ও তার সংগঠনকে নির্যাতনের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। এর প্রকাশ হিসাবে ইতালী এবং জার্মানীতে ফ্যাসিবাদী শক্তির উদ্ভব এবং ফ্যাসি ও নাজীবাদী দল কর্তৃক ইতালী ও জার্মানীতে যথাক্রমে ১৯২৯ ও ১৯৩৩ এ এবং পরবর্তীতে স্পেনে ক্ষমতা দখল করে। পরিণামে ১৯৩৯ এ ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের ক্রমগতিতে ফ্যাসীবাদী ইতালী, জার্মানী ও জাপানের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গণতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রসমূহের একটি বৃহৎ জোট তৈরি হয়। এই জোটের ধনতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী সংস্থা কমিনটার্ন বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অস্তিত্বকে মিত্রজোটের জন্য অবাঞ্চিত বলে গণ্য করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব রক্ষার এই সংকটকালের কথা বিবেচনা করে এবং বিভিন্ন দেশের শ্রমিক আন্দোলন ও তার নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান আদর্শ ও অভিজ্ঞতায় অতীতের চেয়ে অধিক পরিমাণে শক্তিশালী হওয়াতে কোনো ইন্টারন্যাশনাল কেন্দ্রের নেতৃত্বদান আর তত প্রয়োজনীয় নয় বিবেচনা করে সোভিয়েত কমউনিষ্ট পার্টির উদ্যোগে ১৯৪৩ এ তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে দেওয়া হয়।[২]
উল্লেখ্য, সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ত্রৎস্কি বহিষ্কৃত ও রুশ দেশ থেকে বিতাড়িত (১৯২৯) হবার পর তাঁর নেতৃত্বে চতুর্থ আন্তর্জাতিক গঠিত হয় (১৯৩৮) এবং সেটির অস্তিত্ব এখনও ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভালোমতো বিরাজমান ছিলো। চতুর্থ ইন্টারন্যাশনাল সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদের অনুগত দাস হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৪।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৩২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।