ফ্রান্স পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী প্রজাপীড়ক গণবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধী লুটেরানির্ভর প্রজাতন্ত্র

ফ্রান্স (ইংরেজি: France) পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী প্রজাপীড়ক গণতন্ত্র, সাম্য ও স্বাধীনতাবিরোধী লুটেরানির্ভর প্রজাতন্ত্র। আজকের দুনিয়ায় ফ্রান্স একটি স্বকীয় বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। একটি প্রধান পুঁজিবাদী দেশ হিসাবে সে মার্কিন একচেটিয়াদের অভিভাবকত্ব থেকে মুক্তিলাভে সচেষ্ট এবং বাস্তবধর্মী বৈদেশিক নীতি অনুসরণে দৃঢ়সংকল্প। ফ্রান্স ন্যাটোর সামরিক সংস্থাগুলি থেকে সরে এসেছে, দেশ থেকে ন্যাটোর সামরিক কর্মচারী ও ঘাঁটিগুলি হটিয়ে দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে এই আক্রমণাত্মক জোটের সদস্যপদও বজায় রেখেছে। ফরাসি বিপ্লব এই দেশের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পুঁজিবাদী ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত এই দেশটি এশিয়া আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের উপর গত ছয়শ বছর ধরে নিপীড়ন ও শোষণ চালিয়ে আসছে।

ফরাসী শাসকবর্গের স্বাধীন নীতি অনুসরণের একটি গুরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সুবিধাজনক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি উল্লেখ্য। দীর্ঘ মেয়াদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত-ফরাসী সহযোগিতা সম্প্রসারিত হচ্ছে।

ফ্রান্সের ইতিহাস

একটি প্রাচীনতম বিশ্বশক্তি হিসাবে ফ্রান্স প্রায় শতাব্দীকাল আগে অর্থনৈতিক বিকাশের স্তরের বিচারে কেবল ব্রিটেনের পরই দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী ছিল। আজকের ফ্রান্স প্রধান পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে অবস্থিত, যদিও আয়তনের দিক থেকে সে বৃহত্তম পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ (৫ লক্ষ ৫২ হাজার বর্গকিলোমিটার) এবং তার জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লক্ষাধিক।

১৯১০ সালের দিকে ফরাসি আর্মি এয়ার সার্ভিস গঠন করা হলে তা ইউরােপের ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়। পাশাপাশি তাদের সেনা ও নৌবাহিনীও ছিল বেশ বিখ্যাত। ১৯১২ সালের মধ্যেই তারা ফিল্ড আর্মিসহ ফাইভ স্কোয়াড্রন বিমান তাদের সার্ভিসে যুক্ত হয়। প্রায় ৬টির মত বিমান নিয়ে গঠিত হয়েছিল তাদের এক একটি ফিল্ড আর্মি। এদিকে ১৯১৪ সালে না পড়তেই ফ্রান্সের অধিকারে থাকা বিমানের সংখ্যা দেড়শ’ হয়ে যায়। ফারম্যান এমএফ-৭, ফারম্যান এইচএফ-২০ ও ব্লেরিও-১১ বিমান মিলে সংখ্যাটা প্রাথমিকবাবে ১৩২ ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে ১৯১৫ সালের মধ্যেই জার্মান হামলায় ফরাসি বিমান বাহিনী বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ সময় ক্ষতি কাটিয়ে উঠে নতুন করে লড়াই শুরু করার উদ্যোগ হিসেবে ফ্রান্স ২ হাজার ৩০০ বিমান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ভয়েসিন ফাইভ, মরানি সাউলনাই, নিউপাের্ট সেকেন্ড, ফারম্যান এমএফ- সেকেন্ড প্রভৃতি তৈরিতে গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। আর সামার অফেন্সিভ শুরুর আগে পশ্চিম রণাঙ্গনে ফ্রান্স মওজুদ করে প্রায় ১ হাজার ১৪৯টির মত বিমান। তবে দ্রুত ফ্রান্সের বিমান উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯১৭ সালে তা ২ হাজার ৮৭০ হয়েছিল। যুদ্ধ বিরতির পূর্বে ফরাসি বিমান বাহিনীর জনবল ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩ হাজার ২২২টি বিমান। এক্ষেত্রে রেনে ফ্রাঙ্ক, জর্জেজ গাইনেমা, চার্লস নানগেস ও জর্জ ম্যার্ডের মত জগদ্বিখ্যাত বৈমানিক ছিলেন ফ্রান্স বিমান বাহিনীর কর্ণধার।

অ্যাটাচড ক্যাভালরি ও ফিল্ড আর্টিলারিসহ ২১টি আঞ্চলিক কোরের ৪৭টি ডিভিশন নিয়ে ১৯১৪ সালের দিকে গড়ে ওঠে শক্তিশালী ফরাসি সৈন্যদল। এক্ষেত্রে ফরাসি সৈন্য সংখ্যাই ছিল শুরুতে ৭ লাখ ৭৭ হাজার যার সাথে যুক্ত হয়েছিল ঔপনিবেশিক অঞ্চলের আরাে ৪৬ হাজার সদস্য। তবে পশ্চিমের রণাঙ্গনে সব সৈন্য মােতায়েন না করে তাদের বেশিরভাগ সৈন্য মােতায়েন করা হয় পূর্বের রণাঙ্গনে। অনেক সৈন্য ফ্রান্সের অভ্যন্তরে আপকালীন প্রয়ােজন মেটানাের উদ্দেশ্যে অবস্থান নেয়। ১৯১৪ সালের গ্রিষ্ম আসতে না আসতেই আরাে ৪৯ লাখ সৈন্য যুক্ত করে সেনাবাহিনীর কলেবর আরাে বৃদ্ধি করা হয়। যুদ্ধের শুরুতে পশ্চিম রণাঙ্গনে বহু ফরাসি সৈন্য হতাহত হওয়ায় তারা আইন করে ৪৫ বছর বয়সী সব ফরাসি নাগরিকের সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে তােলে। এতে করে সৈন্যসংখ্যা বাড়লেও সেনাবাহিনীর কাঠামাে ও ভারসাম্য দ্রুত ভেঙে পড়ে। 

আরো পড়ুন:  সমরবাদ এমন বিশ্বাস যাতে রাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা বজায় থাকে

১৯১৮ সালের দিকে ফরাসি সৈন্যের ৪০ শতাংশ ছিল গােলন্দাজ। বিশেষ করে ক্রমশ ফরাসি এয়ার সার্ভিস তাদের সৈন্যবাহিনীর তুলনায় অপেক্ষাকৃত সফল হওয়ায় সৈন্য বাহিনীর কলেবর আর না বাড়িয়ে উদ্যোগ নেয়া হয় বিমান বাহিনী শক্তিশালী করার। তবে নির্বিচারে জোর করে দেশের সব নাগরিককে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা ফরাসিদের সর্বনাশ ডেকে আনে। যুদ্ধে প্রায় ১৩ লাখের মত ফরাসি সৈন্য মারা যায়। ১৯১০-১৪ সালের দিকে এসে ফরাসি নৌবাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি তার ব্যয় বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে তােলে। এক্ষেত্রে তাদের বাহিনীতে লভ্য ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার ও সাবমেরিনের সাথে সাথে যুক্ত হয় ১৪টির মত যুদ্ধজাহাজ, ৩২টি ক্রুজার, ৮৬টি ডেস্ট্রয়ার, ৩৪-সাবমেরিন ও ১১৫টি টর্পেডাে বােট। দার্দানেলিস অভিযানের সময় শুরুতেই আক্রান্ত হয়ে ফরাসি বাহিনী পিছু হটে যায়। এরপর ভূমধ্যসাগরে ফরাসি বাণিজ্য জাহাজগুলাের নিরাপত্তা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয় ফরাসি নৌবাহিনী। বিশেষ করে নানা স্থানে শক্তি দেখাতে গিয়ে তাদের মুখােমুখি হতে হয় জার্মান ইউবােটের। বেশ কয়েকটি স্থানে এই ইউবােটের আক্রমণেরই ছত্রখান হওয়ার যােগাড় ফরাসি নৌবাহিনীর বিপরীতে ধ্বংসের মুখে পড়ে তাদের নৌবাণিজ্য।[১]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকেই ফ্রান্সের অর্থনীতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে: ভারী শিল্পের অংশভাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শিল্পোৎপাদন চার গুণেরও বেশি বাড়ে। উৎপাদন ঘনীভবন ও পুঁজি কেন্দ্রীভবন ফরাসী একচেটিয়াদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এসঙ্গে রাষ্ট্রীয়-একচেটিয়া খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছয়।

ফ্রান্সের অর্থনীতি

ফ্রান্স একটি অত্যুন্নত শিল্প ও কৃষিপ্রধান পুঁজিবাদী দেশ। বিশ্বঅর্থনীতিতে আজ তার অংশভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৪৮ সালে যেখানে সে পুঁজিবাদী বিশ্বের মোট শিল্পপণ্যের ৪.৬ শতাংশের উৎপাদক ছিল ১৯৭৭ সালে অঙ্কটি ৬৩ শতাংশে পৌছেছে।[২]

সার্বিক অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বিচারে ফ্রান্স কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, জাপান, পশ্চিম জার্মানি এবং ব্রিটেনেরও পশ্চাদবর্তী। এসব দেশের জাতীয় আয়ের পরিমাণ বৃহত্তর এবং তারা অধিক পরিমাণ তৈরিপণ্য রপ্তানি করে। এদের শিল্প ও কৃষি উৎপাদনের ঘনীভবন ও বিশেষীকরণের স্তরও উন্নততর।

শিল্প ও নির্মাণ ফরাসী অর্থনীতির ভিত এবং ৬০ শতাংশের বেশি জাতীয় আয়ের উৎস। দেশের মোট রপ্তানিমুল্যের অর্ধেকই অর্জিত হয় মানুফ্যাকচারকৃত সামগ্রী থেকে। ভারী ইঞ্জিনিয়রিংই মূলশিল্প এবং এসঙ্গে অত্যুন্নত ভোগ্যপণ্য উৎপাদনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসীন।

ফরাসী শিল্প আকরিকের সদৃঢ় ভিতে প্রোথিত। লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদন ভারী শিল্পের প্রধান শাখা। প্রধানত লরেনি এবং অংশত দেশের উত্তরের কারখানাগুলিতে আমদানিকৃত কোকের সাহায্যে স্থানীয় লৌহ আকরিক থেকে লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদিত হয়। ১৯৭৭ সালে ফ্রান্স ২:২ কোটি টন ইস্পাত উৎপাদন করে। এই ইস্পাতের এক-দশমাংশ তড়িৎ-ইস্পাত এবং মধ্য ও দক্ষিণ ফ্রান্সের তড়িৎ-ধাতুশিল্প কারখানাগুলিতে উৎপন্ন।

আরো পড়ুন:  ব্যর্থ রাষ্ট্র হচ্ছে কেন্দ্রীভূত সামরিক কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র

বক্সাইটের সমৃদ্ধ খনি এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে উৎপন্ন সস্তা জলবিদ্যুতের সমন্বয় ঘটায় দেশে অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদন যথেষ্ট বুদ্ধি সম্ভব হয়েছে। অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপানের পরই ফ্রান্সের স্থান এবং সে এক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে অগ্রগামী।

ফরাসী শিল্পের মূল কাঠামো ইঞ্জিনিয়রিং এখন ধাতুশিল্পের দৃঢ় ভিতের উপর বিকশিত হচ্ছে। তার পরিবহণ যন্ত্রাদি নির্মাণ, বিদ্যুৎ-ইঞ্জিনিয়রিং এবং যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ শিল্প বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। ফরাসী যুদ্ধাস্ত্র শিল্প ট্রাটেজিক বোমার বিমান, ব্যালেস্টিক মিসাইল, পারমাণবিক অস্ত্র, পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন এবং অন্যান্য ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সাজসরঞ্জাম তৈরি করে।

বিদ্যুৎ-ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প দেশ ও বিদেশের বাজারের জন্য বিবিধ সামগ্রী (ইলেকট্রিক ট্রাকসন মেশিন, ট্রান্সফর্মার এবং গৃহস্থালীর বিজলি সরঞ্জাম) উৎপাদন করে। দেশে ইলেকট্রনিক যন্ত্র, বিশেষত কম্পিউটার উৎপাদন এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। ইদানীং যন্ত্রনির্মাণ শিল্প স্বদেশ ও অন্য কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্রের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্টেশনের সাজসরঞ্জাম তৈরি করছে।

মোটরগাড়ি তৈরির কারখানাগুলি পরিবহণ যন্ত্রনির্মাণ শিল্পের একটি বিশিষ্ট অনুষঙ্গ। এক্ষেত্রে বৃহত্তম মোটরনির্মাতা দেশগুলির মধ্যে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে সে তৃতীয় স্থানের অধিকারী। ‘রেনো’ কারখানার জাতীয়কৃত সংস্থাগুলি থেকেই ফরাসী মোটরের প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপন্ন ও রপ্তানি করা হয়।

ইঞ্জিনিয়রিং শিল্পের একটি প্রধান ও দীর্ঘ-প্রতিষ্ঠিত শাখা জাহাজনির্মাণ মার্সাই, তুলোঁ, বদো, ব্রেস্ত, হাভর ও অন্যান্য বন্দরে কেন্দ্রিত। বিমাননির্মাণের পরিমাণের দিক থেকে পুঁজিবাদী বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পরই ফ্রান্স তৃতীয় স্থানের অধিকারী।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই রাসায়নিক ও তৈল-রাসায়নিক শিল্প উল্লেখ্য স্থান দখল করে। আকরিক সার, অ্যাসিড এবং অন্যান্য প্রচলিত রাসায়নিক দ্রব্যাদি ছাড়াও এগুলি প্লাস্টিক, কৃত্রিম রবার ও আঁশের উৎপাদন বাড়াচ্ছে, ওষুধ তৈরিও ত্বরিত হয়েছে।

সীমিত জ্বালানি ও শক্তির ভিত ফরাসী শিল্পের এবং সামগ্রিকভাবে তার অর্থনীতির একটি দুর্বল গ্রন্থি। ফ্রান্সের কয়লাখনি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং কয়লাও নিম্নমানের আবিষ্কৃত তৈল ও গ্যাসের অবস্থাও তদ্রুপ। তাই শোধনাগারগুলির জন্য সে প্রধানত মধ্য প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে তৈল আমদানি করে। এসব শোধনাগারে বছরে প্রায় ১৭ কোটি টন অশোধিত তৈল শোধিত হয়। ফ্রান্স বছরে ২২,৫০০ কোটির বেশি কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং এর অধিকাংশই দক্ষিণের পার্বত্য নদীর জলবিদ্যুৎ স্টেশনে উৎপন্ন হয়। পারমাণবিক শক্তি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে ফ্রান্স পথিবীর অন্যতম অগ্রগণ্য দেশ।

ফরাসী কৃষি খুবই উন্নত। বাজারজাত ফসলের হিসাবে পুঁজিবাদী বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পর সে তৃতীয় স্থানের অধিকারী। গবাদি পশুপ্রজন, খামার ও গব্যশালা সারা দেশে বহুব্যাপ্ত। মাংস, দুধ, ডিম, গম (বছরে প্রায় ৪ কোটি টন), চিনি-বীট (প্রায় ২৩ কোটি টন) উৎপাদনে পুঁজিবাদী ইউরোপে সে উচ্চ স্থানে অবস্থিত। উত্তরের সমতল ও অ্যাকুইতেন অববাহিকার গমখেতগুলি দেশের প্রধান গম-উৎপাদক অঞ্চল। লেঙ্গুইদক ফ্রান্সের আঙুরচাষের কেন্দ্র। পৃথিবীর আর কোনো দেশেই এত পরিমাণে এমন সেরা আঙুরের মদ তৈরি হয় না।

প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বৈচিত্র্য এবং কোনো কোনো এলাকার আত্যন্তিক বিশেষীকরণের প্রেক্ষিতে ফ্রান্স কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভাজ্য।

আরো পড়ুন:  বিস্তারবাদ বা সম্প্রসারণবাদ গঠিত হয় রাষ্ট্রের নীতিগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে

ফরাসী রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সত্তারূপী প্যারিস শিল্প-কৃষি এলাকাটি দেশের প্রধান শিল্প, পরিবহণ, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। দেশের রাজধানী প্যারিস (জনসংখ্যা ১ কোটির বেশি) বহুসংখ্যক ইঞ্জিনিয়রিং, রাসায়নিক, যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ এবং হালকা ও খাদ্য শিল্পে সমৃদ্ধ । ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন কিছুকাল প্যারিসে বাস করেছিলেন। এই শহরের শ্রমিক শ্রেণী দীর্ঘকালীন বৈপ্লবিক ঐতিহ্যের অধিকারী।

অন্যান্য অত্যধিক শিল্পোন্নত কেন্দ্র হল : লিল শহর কেন্দ্রিক উত্তর শিপাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব শিল্প-কৃষি অঞ্চল (লরেনের ধাতুশিল্প এবং আলসাসের বস্ত্রশিল্প ও রাসায়নিক শিল্প)। প্যারিস, উত্তর ও উত্তর-পূর্বের অঞ্চলগুলি একত্রে দেশের এক-চতুর্থাংশ আয়তন, অর্ধেক জনসংখ্যা এবং ৬০ শতাংশ শিল্পসামর্থ্যের অধিকারী।

লিয়োঁ বা দক্ষিণ-পূর্ব শিল্প-কৃষি অঞ্চলের (কেন্দ্রগুলি লিয়োঁ ও সাঁ এতিয়েন) এবং ভূমধ্যসাগরীয় কৃষি-শিল্প অঞ্চলের শিল্প ও কৃষি খুবই উন্নত। আঙুর ও শাকসজির জন্য বিখ্যাত এই শেষোক্ত অঞ্চলে মাসই অবস্থিত। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর, একটি গুরত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র এবং ফ্রান্সের বৃহত্তম বন্দর। ফরাসী রিভিয়েরা অন্যতম ইউরোপীয় ভ্রমণকেন্দ্র।

কেন্দ্রীয় (কেন্দ্র: ক্লেরমোঁ-ফেরাঁ), দক্ষিণ-পশ্চিম (তুলজ) এবং উত্তরপশ্চিম (নান, ত) অঞ্চলগুলি অর্থনৈতিকভাবে ফ্রান্সের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত কৃষি-শিল্প এলাকা। বদো, নানত, ব্রেস্ত ও শেরবর্গ বন্দরাঞ্চল ফ্রান্সের ‘আটলান্টিক বাঁধ’ হিসাবে খ্যাত। বিদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এগুলি ও অন্যান্য বন্দর তার সংযোগসূত্র।

ফ্রান্সের বহির্বাণিজ্যিক আবর্তনের প্রায় অর্ধেকই সাধারণ বাজারের দেশগুলিভুক্ত। এক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থান এর পরবর্তী। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ফ্রান্সের পণ্যবিনিময় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশের অভ্যন্তরীণ মঞ্চে একচেটিয়ারা মেহনতিদের অধিকার ও স্বার্থের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। অভাব ও দারিদ্র আজিকার ফ্রান্সের এক নৈমিত্তিক ঘটনা। বেকার ও কর্মরত উভয়তই প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ মেহনতি মানুষ নিজ ও তাদের পরিবারের জন্য অতি-প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে বঞ্চিত। একই সময় মাত্র কয়েক হাজার ধনিক অভূতপর্বে প্রাচুর্যের অধিকারী হয়ে উঠছে। তাই নিজ স্বার্থরক্ষার জন্য ফরাসী শ্রমিক শ্রেণী ও লক্ষ লক্ষ মেহনতির সংগ্রাম চলছে। রাষ্ট্রীয়-একচেটিয়া পুঁজির আক্রমণের বিরদ্ধে শ্রেণী-সংগ্রামে মেহনতিরা অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

তথ্যসূত্র

১. মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, [Pdf]. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি ২০১৯. সানজিদা মুস্তাফিজ ও সুমা কর্মকার. সম্পা. পৃষ্ঠা ৩৪; Retrieved from http://www.ebookbou.edu.bd/wp/OS/hsc4_2.php#hsc2855
২. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ১৮৫-১৮৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!